সন্ধ্যাবেলায় দেখেছি; আমার বাইরের ঘরের বালঘাটা আবার চল্লিশ পাওয়ারের।
তাও বলুন।
চওড়া মুখ। চোখ, আপনার-ইয়ে, চোখে চশমা; দাঁড়ি আছে, চাপ দাড়ি, গোঁফ। আছে।–দাড়ির সঙ্গে জোড়া–
ফ্রেঞ্চকাট?
এই সেরেছে। না, তা বোধহয় না। কুলপির সঙ্গেও জোড়া।
তারপর?
কাঁচাপাকা মেশানো চুল। ডান দিকে-না না, বাঁ দিকে সিঁথি।
দাঁত।
পরিষ্কার। ফলস-টিথ বলে তো মনে হল না।
গলার স্বর।
মাঝারি। মানে, মোটাও না। সরু ও না।
হাইট?
মাঝারি।
ভদ্রলোক আপনাকে একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন না? বম্বের? বলেছিলেন অসুবিধা হলে একে ফোন করবেন—বেশ হেলপাফুল?
দেখেছেন! বেমালুম ভুলে গেসলুম! আজি যখন পুলিশ জেরা করল, তখনও বলতে ভুলে গেলুম।
আমাকে বললেই চলবে।
দাঁড়ান, দেখি।
লালমোহনবাবু মানিব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ-করা নীল কাগজ বার করে ফেলুদাকে দিলেন। ফেলুদা সেটা খুব মন দিয়ে দেখল, কারণ লেখাটা মিঃ সান্যালের নিজের। তার পর কাগজটা আবার ভাঁজ করে নিজের ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়ে বলল :
তোপ্সে, নম্বরটা চা তো—টু ফাইভ থ্রি ফোর ওয়ান এইট।
আমি অপারেটরকে নম্বর দিয়ে দিলাম। ফেলুদা ইংরাজিতেই কথা বলল।
হ্যালো, মিস্টার দেশাই আছেন?
আচ্ছা ফ্যাসাদ। এই নম্বরে মিঃ দেশাই বলে কেউ নাকি থাকেই না। যিনি থাকেন, তাঁর পদবি পারেখ, আর গত দশ বছর তিনি এই নম্বরেই আছেন।
লালমোহনবাবু, ফেলুদা ফোনটা রেখে বলল, সান্যালকে আপনার নেকস্ট গল্প বিক্রি করার আশা ছাড়ুন। লোকটি অত্যন্ত গালমেলে এবং আমার বিশ্বাস আপনি যে প্যাকেটটি বয়ে আনলেন, সেটিও অত্যন্ত গোলমেলে।
লালমোহনবাবু মাথা চুলকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সত্যি বলতে কী মশাই, লোকটিকে আমারও কেন জানি বিশেষ সুবিধের বলে মনে হয়নি।
ফেলুদা হুমকি দিয়ে উঠল।
আপনার ওই কেন জানি কথাটা আমার মোটেই ভাল লাগে না। কেন সেটা জানতে হবে, বলতে হবে। চেষ্টা করে দেখুন তো পারেন কি না।
লালমোহনবাবুর অবিশ্যি ফেলুদার কাছে ধমক খাওয়ার অভ্যোস আছে। এটাও জানি যে উনি সেটা মাইন্ড করেন না, কারণ ধমক খেয়ে খেয়ে ওঁর লেখা যে অনেক ইমপ্রুভ করে গেছে, সেটা উনি নিজেই স্বীকার করেন।
লালমোহনবাবু সোজা হয়ে বসলেন। এক নম্বর, লোকটা সোজাসুজি মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। দুই নম্বর, সব কথা অত গলা নামিয়ে বলার কী দরকার তাও জানি না। যেন কোনও গোপন পরামর্শ করতে এসেছেন। তিন নম্বর…
দুঃখের বিষয়, তিন নম্বরটা যে কী, সেটা লালমোহনবাবু অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না।
সাড়ে ছটায় লোটাসে ইভনিং শো, তাই আমরা ছটা নাগাদ উঠে পড়লাম। আমরা মানে আমি আর লালমোহনবাবু। ফেলুদা বলল যাবে না, কাজ আছে। ব্যাগের ভিতর থেকে ওর সবুজ নাটবইটা বেরিয়ে এসেছে, তাই কাজটা যে কী সেটা বুঝতে বাকি রইল না।
ওয়ারলিতে ফিরে যেতে হলে আমাদের, কেননা সেখানেই লোটাস সিনেমা। লালমোহনবাবু বেশ নার্ভাস অবস্থা; পুলকবাবু কেমন পরিচালক, সেটা তীরন্দাজ ছবি দেখেই মালুম হবে। বললেন, তিনটে ছবি যখন পর পর হিট করেছে, তখন একেবারে কি আর ওয়্যাক-থু হবে? কী বলো, তপেশ?
আমি আর কী বলব? আমি নিজেও তো ঠিক ওই কথাটা ভেবেই মনে জোর আনছি। পুলকবাবু ম্যানেজারকে বলতে ভোলেননি; রয়েল সার্কলে তিনটে সিট আমাদের জন্য রাখা ছিল।, এটা ছবির রিপিট শো, তাই হলে এমনিতেই অনেক সিট খালি ছিল।
ইন্টারভ্যালের আগেই বুঝতে পারলাম যে তীরন্দাজ হচ্ছে একেবারে সেন্ট পার্সেন্ট কোড়োপাইরিন-মার্কা ছবি। এর মধ্যেই অন্ধকারে বেশ কয়েকবার আমরা দুজনে পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছি। হাসি পাচ্ছিল, আবার সেই সঙ্গে জেট বাহাদুরের কী অবস্থা হবে আর তার ফলে জটায়ুর কী অবস্থা হবে, সেটা ভেবে কষ্টও হচ্ছিল। ইন্টারভ্যালে বাতি জুললে পর লালমোহনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, গড়পারের ছেলে-তুই অ্যাদ্দিন এই করে চুল পাকালি? তারপর একটা গ্যাপ দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, ফি পুজোয় পাড়ায় একটা করে থিয়েটার করত; যদ্দূর মনে পড়ছে বি কম ফেল —তার কাছ থেকে আর কী আশা করা যায়, বলো তো?
ইন্টারভ্যালের শেষে বাতি নেভার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ভয় ছিল, পুলকবাবু বা তার দলের কেউ যদি বাইরে থাকে; কিন্তু সে রকম কাউকে দেখলাম না।
যদি জিজ্ঞেস করে তো বলে দেবী ফাস্ট ক্লাস। পকেটে কিরকরে নোটগুলো না থাকলে মনটা সত্যিই ভেঙে যেত তপেশ।
গাড়িটা হাউসের সামনেই উলটাদিকের ফুটপাতে পার্ক করা ছিল। লালমোহনবাবু সে দিকে না গিয়ে একটা দোকানে ঢুকে এক ঠোঙা ডালমুট, দু প্যাকেট মাংঘারামের বিস্কুট, ইটা কমলালেবু আর এক প্যাকেট প্যারির লজঞ্চুস কিনে নিলেন। বললেন, হাটেলের ঘরে বসে। বৰুসে হঠাৎ হঠাৎ খিদে পায়, তখন এগুলো কাজে দেবে।
দুজনে দুহাত বোঝাই প্যাকেট নিয়ে গাড়িতে উঠলাম, আর উঠেই বাঁই করে মাথাটা ঘুরে গেল।
গাড়ির ভিতরে গুলবাহার সেন্টের গন্ধ।
আসার সময় ছিল না; এই দেড় ঘন্টার মধ্যে হয়েছে।
মাথা ঝিমে ঝিম করছে, তপেশী, বললেন লালমোহনবাবু। এ ভূতের উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই না। সান্যাল খুন হয়েছে, আর তার সেন্ট-মাখা ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপেছে।
আমার মনে হল-ঘাড়ে নয়, গাড়িতে চেপেছে; কিন্তু সেটা আর বললাম না।
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, সে বেশির ভাগ সময় গাড়িতেই ছিল, কেবল মিনিট পাঁচেকের জন্য কাছেই একটা রেডিয়ো-টেলিভিশনের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফুল খিলে হয় গুলশন গুলশন দেখেছে। হ্যাঁ, গন্ধ সেও পাচ্ছে বইকী, কিন্তু গাড়ির ভিতরে কী করে এমন গন্ধ হয়, সেটা কিছুতেই তার মগজে ঢুকছে না। ব্যাপারটা তার কাছেও একেবারেই আজব।