লালমোহনবাবুকে বার বার এভাবে চমকাতে হচ্ছে—আশা করি তাতে ওঁর হার্ট-টার্টের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না।
পুলকবাবু কি? টেলিফোনের দিকে যাবার পথে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
নো স্যার, বললেন মিঃ গোরে। আই ডোন্ট নো দিস পারসন।
হ্যালো।
ফেলুদা আড়চোখে দেখছে লালমোহনবাবুর দিকে।
হ্যালো…হ্যালো…
লালমোহনবাবু ভ্যাবাচ্যাক ভাব করে আমাদের দিকে চাইলেন।
কেউ বলছে না কিছু।
লাইন কাট গিয়া হোগা, বললেন মিস্টার গোরে।
লালমোহনবাবু মাথা নাড়লেন! অন্য সব শব্দ পাচ্ছি টেলিফোনে।
এবার ফেলুদা উঠে গিয়ে লালমোহনবাবুর হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে নিল।
হ্যালো, হ্যালো…
ফেলুদা মাথা নেড়ে ফোন রেখে বলল, ছেড়ে দিয়েছে।
আশ্চর্য, বললেন লালমোহনবাবু, কে হতে পারে, বলুন তো?
ও নিয়ে চিন্তা করবেন না, মিস্টার গাঙ্গুলী, বললেন মিঃ গোরে। বাম্বাই শহরে এই রকম হামেশা হয়।
ফেলুদার দেখাদেখি আমরাও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। লালমোহনবাবুর পকেটে এত টাকা বলেই বোধহয় রহস্যজনক ফোনের ব্যাপারটা ওঁকে ততটা ভাবাল না। বেশ নিশ্চিন্তভাবেই ভদ্রলোক পরের কথাটা বললেন মিঃ গোরেকে।
হাঁ, হাঁ যাবেন বইকী। ভেরি গুড ডিরেক্টর পুলকবাবু। জেট বাহাদুর ভি বকস অফিস হিট হোগা জরুর।
দরজার, মুখ পর্যন্ত এলেন মিঃ গোরে। ডোন্ট ফরগেট অ্যাবাউট লাঞ্চ টুমরো। ট্রানসপোর্ট আছে তো আপনাদের সঙ্গে?
আমরা আশ্বাস দিলাম যে, সকাল থেকে রাত অবধি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন পুলকবাবু।
বাইরে বেরিয়ে এসে লিফটের বোতাম টিপে ফেলুদা বলল, মানি কাকে বলে দেখলেন তো লালমোহনবাবু?
দেখলাম কি মশাই, তার খানিকটা তো আমার পকেটেই রয়েছে।
নস্যি, নাস্যি। লাখ টাকাও এদের কাছে নস্যি। টাকাটা দিয়ে রসিদ লিখিয়ে নিল না, সেটা দেখলেন তো? তার মানে আপনার পকেটটা কালো হয়ে গেছে। কিন্তু। অৰ্থাৎ এই আপনার অন্ধকারে পদার্পণ শুরু।
ঘড়াং শব্দে লিফটটা উপরের কোনও ফ্লোর থেকে নেমে এসে আমাদের সামনে থামল।
সে আপনি যাই বলুন ফেলুবাবু, পকেটে টাকা এলে তা সে কালোই হাক, আর—
ফেলুদা লিফটে ঢোকার জন্য দরজা খুলেছিল, আর তার ফলেই জটায়ুর কথা বন্ধ।
লিফটের ভিতর থেকে এক ঝলক উগ্ৰ গন্ধ। গুলবাহার সেন্ট। এ গন্ধ আমরা তিনজনেই চিনি; বিশেষ করে লালমোহনবাবু।
টিপু টিপ বুকে ফেলুদার পিছন পিছন লিফটে ঢুকে গেলাম।
আমি একটা কথা না বলে পারলাম না।
গুলবাহার সেন্ট মিঃ সান্যাল ছাড়াও ভারতবর্ষের অনেকেই নিশ্চয়ই ব্যবহার করে।
ফেলুদা কথাটার জবাবের বদলে গভীরভাবে সতেরো নম্বর বাতাম টিপল। আমরা আরও পাঁচতলা ওপরে উঠে গেলাম।
অন্যান্য তলার মতোই সতেরো নম্বরেও তিনখানা ঘর। বাঁ দিকের দরজায় লেখা এইচ হেক্রথা। ফেলুদা বলল, জামান নাম। ডান দিকের দরজায় লেখা এন সি মানসুখানি। নিঘাত সিন্ধি নাম। মাঝখানের দরজায় কোনও নাম নেই।
ফ্ল্যাট খালি, বললেন লালমোহনবাবু।
নাও হতে পারে, বলল ফেলুদা।সবাই দরজায় নাম লাগায় না। ইন ফ্যাক্ট, আমার বিশ্বাস এ ফ্ল্যাটে লোক রয়েছে।
আমরা দুজনেই ফেলুদার দিকে চাইলাম।
যে কলিং বেলের বোতাম ব্যবহার হয় না, তাতে ধুলো জমে থাকা উচিত। অথচ এটা ভাল করে কাছ থেকে দেখুন, আর অন্য দুটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন।
কাছে গিয়ে দেখেই বুঝলাম, ফেলুদা ঠিক বলেছে। দিব্যি চকচক করছে বোতাম, ধুলোর লেশমাত্র নেই।
টিপবেন নাকি? কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা অবিশ্যি বোতাম টিপল না। তার বদলে যেটা করল, সেটা আরও অনেক বেশি তাজ্জব ব্যাপার। —মাটিতে উপুড় হয়ে সটান শুয়ে নাকটা লাগিয়ে দিল দরজার নীচে আধ ইঞ্চি ফাঁকাটাতে। তারপর বার দুয়েক জোরে নিশ্বাস টেনে উঠে পড়ে বলল, কড়া কফির গন্ধ।
তারপর যেটা করল, সেটাও অদ্ভুত। লিফট ব্যবহার না করে আঠারো তলা থেকে সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল। প্রত্যেক তলাতেই থেমে প্রায় আধ মিনিট ধরে ঘুরে ঘুরে কী যে দেখল, তা ওই জানে।
সব সেরে নীচে যখন নামলাম, তখন ঘড়িতে পাঁচটা বেজে দশ।
বেশ বুঝতে পারছি যে, বম্বে এসে আমরা একটা প্যাঁচালো রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি।
০৭. একটু জেরা করলে
আপনাকে একটু জেরা করলে আপনার আপত্তি হবে না আশা করি।
কথাটা বলল ফেলুদা, লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ করে। মিনিট দশেক হল শিবাজী কাসল থেকে ফিরেছি–রিসেপশনে খবর পেয়েছি যে এই আধা ঘন্টা আগে।–তার মানে যখন আমরা শিবাজী কাসূলের সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন-লালমোহনবাবুর একটা ফোন এসেছিল; কে করেছিল তা জানা নেই।
আসলে পুলকই বারবার করছে, বললেন লালমোহনবাবু।পুলক ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।
এখন আমাদের ঘরে বসে ফেলুদার প্রশ্নটা শুনে লালমোহনবাবু বললেন, পুলিশের জেরাতেই যখন ফ্লাইং কালারসে বেরিয়ে এলুম, তখন আর আপনার জেরায় কী আপত্তি থাকতে পারে?
আচ্ছা, মিঃ সান্যালের প্রথম নামটা তো আপনার জানা নেই।
না মশাই, ওটা জিজ্ঞেস করা হয়নি।
লোকটার একটা পরিষ্কার বর্ণনা দিন তো! আপনার বইয়ে যে রকম আধাখেচড়া বর্ণনা থাকে, সে রকম নয়।
লালমোহনবাবু গলা খাঁকরিয়ে ভুরু কুঁচকোলেন।
হাইট…এই ধরুন গিয়ে—
আপনি কি একটা মানুষের হাইটটাই প্রথম দেখেন?
তা তেমন তেমন লম্বা বা বেঁটে হলে–
ইনি কি খুব লম্বা?
তা অবিশ্যি না।
খুব বেঁটে?
না, তাও অবিশ্যি না।
তা হলে হাইট পরে। আগে মুখ বলুন।