আইয়ে মিস্টার মিত্ৰা-ট্রাই কিজিয়ে-ইটস নট সে ডিফিকাল্ট।
বাকি যারা ট্রেনিং নিচ্ছিল, তারা গদি ছেড়ে সরে গেল। পেরুমাল একটা ছোট্ট লাফের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে ডান পা-টা মাথা অবধি তুলে সোজা সামনের দিকে ছিটকে দিল। পায়ের সামনে কেউ থাকলে নিঘাঁত ধরাশায়ী হত! ফেলুদা গদির উপর উঠে পাঁচ-ছ বার ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিয়ে শরীরটাকে তৈরি করে নিল। পেরুমাল ফেলুদার থেকে হাত চারেক দূরে দাঁড়িয়ে বলল, আমার দিকে ছোঁড়ো পা।
পেরুমলের জানার কথা নয় যে, এনটার দ্য ড্রাগন দেখার পর থেকে মাস কয়েক ধরে প্রায়ই সকলে ফেলুদা আমাদের বৈঠকখানায় কুং-ফুর ঢঙে হাত পা ছোঁড়া অভ্যোস করেছে। ফুর্তি ছাড়া এর পিছনে আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না ঠিকই, কিন্তু পা ছোঁড়ার কায়দাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। w
ওয়ান-টু-থ্রি বলার সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদার ডান পা-টা হারাইজন্ট্যালভাবে বিদ্যুদ্বেগে সামনের দিকে ছিটকে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে পেরুমলের শরীরটা পিছনে ছিটকে গিয়ে আছাড় খেল গদির উপর—যদিও আমি জানি যে ফেলুদার পা তার গায়ে লাগেনি।
তারপর এইভাবে পাঁচ মিনিট ধরে চলল। ভিক্টর পেরুমাল আর প্রদোষ মিত্তিরের কুং-ফুর ডেমনষ্ট্রেশন। আমার দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল পেরুমলের সাকরেদদের দিকে-দেড় মাস ধরে লাফ-বাঁপি করে যাদের জিভ বেরিয়ে এসেছে। এটা দেখে ভাল লাগল যে, হিংসার চেয়ে ংসার ভাবটাই তাদের মুখে বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। পাঁচ মিনিটের শেষে যখন দুজনে হ্যান্ডশেক করে পরস্পরের পিঠ চাপড়াচ্ছে, তখন সকলে হাততালি দিয়ে উঠল।
০৬. পুলকবাবু আর সংলাপ-লেখক ত্ৰিভুবন গুপ্ত
দুটো নাগাদ পুলকবাবু আর সংলাপ-লেখক ত্ৰিভুবন গুপ্তের সঙ্গে আমরা ওয়ারলির কপার চিমনি রেস্ট্যোর্যান্টে লাঞ্চ খেতে ঢুকলাম। দেখে মনে হয়। তিলধরার জায়গা নেই, কিন্তু পুলকবাবু আমাদের জন্য একটা টেবিল আগে থেকেই রিজার্ভ করে রেখেছেন।
লালমোহনবাবু বললেন, আমাদের ছবির নামটা কী হচ্ছে ভাই পুলক?
নামের কথাটা অবিশ্যি আমারও অনেকবার মনে হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সুযোগটা আসেনি। বোম্বাইয়ের বোম্বেটে নাম যে থাকবে না সেটা আমিও আন্দাজ করেছিলাম।
আর বলবেন না লালুদা, বললেন পুলকবাবু; নাম নিয়ে কি কম হুজ্জত গেছে? যা ভাবি, তাই দেখি হয় হয়ে গেছে, না হয়। অন্য কোনও পার্টি রেজিস্ট্রি করে বসে আছে। গুপ্তেজিকে জিজ্ঞেস করুন না, কত বিনিদ্র রজনী গেছে। ওঁর নাম ভেবে বার করতে? শেষটায় এই তিনদিন আগে-যা হয়। আর কী-হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক।
হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক? ছবির নাম হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক? লো-ভোল্টেজ গলার স্বরে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
পুলকবাবু হা-হা করে হেসে চারিদিকের টেবিলের লোকদের মাথা আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, মাথা খারাপ লালুদা? ও নামে ছবি চলে? আমি ইনস্পিরেশনের কথা বলছি। জেট বাহাদুর।
অ্যাঁ?
জেট বাহাদুর। রাস্তায় হার্ডিং পড়ে যাবে আপনারা থাকতে থাকতেই। ভেবে দেখুন–আপনার গল্পের এর চেয়ে ভাল নাম আর খুঁজে পাবেন না। অ্যাকশন, স্পিড, থ্রিল-জেট কথাটার মধ্যে আপনি সব পাবেন। প্লাস বাহাদুর। নাম আর কাস্টিং-এর জোরেই আল সার্কিটস সোল্ড।
লালমোহনবাবুর হাসির ভোল্টেজটা যেন বাড়তে গিয়ে কমে গেল। বোধহয় ভাবছেন-শুধুই নাম আর কাস্টিং? গল্পের কি তা হলে কোনও দামই নেই?
আমার কোনও ছবি আপনার দেখেছেন, লালুদা? বললেন পুলকবাবু। তীরন্দাজটা হচ্ছে লোটাসে। আজ ইভনিং শো-এ দেখে আসুন। আমি ম্যানেজারকে বলে দেব-তিনখানা সার্কলের টিকিট রেখে দেবে। ভাল ছবি-জুবিলি করেছিল।
আমরা পুলকবাবুর কোনও ছবি দেখিনি। লালমোহনবাবুর স্বাভাবিক কারণেই কৌতুহল ছিল, তাই যাব বলেই বলে দিলাম। বম্বেতে চেনাশোনা না থাকলে সন্ধে কাটানো ভারী মুশকিল। গাড়িটা আমাদের কাছেই থাকবে-তাকে বললেই লোটাসে নিয়ে যাবে।
খাবার মাঝখানে রেস্টোর্যান্টের একজন লোক পুলকবাবুকে এসে কী যেন বলল। পুলকবাবুর যে এখানে যাতায়াত আছে, সেটা ঢোকার সময় ওয়েটারদের মুখে হাসি দেখেই বুঝেছি। হিট ডিরেক্টরের এ শহরে খুব খাতির।
পুলকবাবু কথাটা শুনেই লালমোহনবাবুর দিকে ফিরলেন।
আপনার টেলিফোন, লালুদা।
লালমোহনবাবু ভাগ্যিস পোলাওয়ের চামচটা মুখে পোরেননি, তা হলো নিঘাত বিষম খেতেন। এ অবস্থায় চমকানোটা কেবল খানিকটা পোলাও চামচ থেকে ছিটকে টেবিলের চাদরে পড়ার উপর দিয়ে গেল।
মিস্টার গোরে ডাকছেন, বললেন পুলকবাবু। হয়তো কিছু গুড নিউজ থাকতে পারে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে টেলিফোন সেরে এসে লালমোহনবাবু আবার কাঁটাচামচ হাতে তুলে নিয়ে বললেন, চারটের সময় ভদ্রলোকের বাড়িতে যেতে বললেন। কিছু অর্থপ্ৰাপ্তি আছে বলে মনে হচ্ছে-হে হে।
তার মানে আজ বিকেলের মধ্যে লালমোহনবাবুর পকেটে দশ হাজার টাকা এসে যাবে। ফেলুদা বলল, এর পরের দিন লাঞ্চটা আপনার ঘাড়ে। আর কপার-স্টপার নয়, একেবারে গোলেণ্ডন চিমনি।
রুমালি রুটি, পোলাও, নাবিগিসি কোফুতা আর কুলপি খেয়ে যখন রেস্টোর্যান্ট থেকে বেরেলাম, তখন প্রায় পৌনে তিনটে। পুলকবাবু আর মিস্টার গুপ্তে স্টুডিয়ে চলে গেলেন। সংলাপ এখনও কিছু লিখতে বাকি আছে। প্রত্যেকটা সংলাপ, শানিয়ে লিখতে হয়। তো, তাই নাকি সময় লাগে, বললেন, পুলকবাবু; গুপ্তেজি চুরুটের ফাঁক দিয়ে একটু হাসলেন। ভদ্রলোক সংলাপ লিখলেও নিজে সংলাপ খুবই কম বলেন, সেটা লক্ষ করলাম।