হাত তিনেক গিয়েছিলুম। আহা! এলিসের ওয়ান্ডারল্যান্ড। সোঁ সোঁ করে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছে। ছোট একটা ছেলে পেলে দেখে নিতুম, শেষ কোথায়?
এইরকম একটি বাড়িতে রক্ত আমাশার মতো অসুখ। কার্বাইডের ড্রামে ভরতি জল। প্রায় শেষ করে ফেলেছি। একতলার পাতকোর থেকে টেনে টেনে জল ভরতে হবে ভাবলেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। খালি যখন করেছি ভরতে তো হবেই। আইন হল আইন। শুনেছি এই আইনের ঠ্যালায়। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই আধমরা হয়ে ছিলেন। সারা ভারত জুড়ে মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন চললেও, গঙ্গার তীরবর্তী এই ক্ষুদ্র জনপদের ভুতুড়ে বাড়িতে আইন অমান্যের সাহস কারুর ছিল না। দুঃখের দিনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে মনের দেয়ালে সারি সারি বীর, যোদ্ধা, মহাপুরুষদের ঝুলিয়ে রাখতে হয়। সামনে দাঁড়াও। চোখ বুজিয়ে বলল, শক্তি দাও, একটু স্পিরিট ধার দাও। রোমেলকে স্মরণ করি। এই অবস্থায় রোমেল না হলে উদ্ধারের আশা খুবই অল্প। শুয়ে শুয়ে মার খেতে হবে। সেই অনুচ্ছেদটি একবার ঝালিয়ে নিই। রোমেলের জীবনীর তেত্রিশ পাতায় নীচের দিকে আছে। ১৯১৪ সাল। আমি তখন কোথায়? ২২ অগাস্ট! ভোর পাঁচটা। স্থান, ফরাসি দেশ। গ্রামের নাম ব্লিইড। ফরাসিদের আক্রমণ করতে চলেছেন যুবক রোমেল। ধরা যাক, এখন আমার যা বয়েস, তখন তার সেই বয়েস। রোমেল যাবেন যুদ্ধে, আমি যাব ড্রামে জল ভরতে। দু’জনের শরীরের অবস্থাই সমান। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে রোমেল ঘোড়ার পিঠে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার ওপর খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে পেট ছেড়েছে। শরীর ভেঙে আসছে। ঘোড়ার জিন থেকে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হচ্ছে। তবু পড়ছেন না, কারণ তিনি রোমেল। রোমেল অসুস্থ হতে পারেন, কিন্তু মুখ চুন করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসতে পারেন না। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন ঘোড়ার পিঠে। জ্ঞান ফিরে এলেই বলছেন, নেভার মাইন্ড। জার্মান ভাষায় নেভার মাইন্ডের অনুবাদ জানা নেই। ইংরেজির মতো অতটা মোলায়েম হবে না। গাবদা গোবদা ভাষা। উচ্চারণে হাপরের মতো বাতাস বেরোবে। শব্দেই চাঙ্গা। ঠিক হোকনা-হোক আমারও একটা শব্দ চাই। রোমেল কুয়াশা ভেদ করে যুদ্ধের দিকে চলেছেন। আমি ধেড়ে বালতি হাতে ভাঙাভাঙা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামব। রোমেলের ফুডপয়জনিং, আমার পেটে মাতামহের খাদ্যতালিকার প্রলয় নাচন। ও নটরাজ, নটরাজ, প্রলয় নাচন নাচবে যখন। আলোচালের ফ্যানটাই মনে হয় প্রধান আসামি। নেভার মাইন্ড! গুটেনবার্গেন হ্যাফট হাফেভেন।
জল-ভরতি বালতির টানে উলটে ডিগবাজি খেয়ে পাতকোর মধ্যে পড়ে যাবার মতো হচ্ছে। হঠাৎ হোয়াইট নাইটের কথা মনে পড়ল। জলকে আমার দিকে আকর্ষণ না করে, জল যদি আমাকে জলের দিকে আকর্ষণ করত তা হলে বাপারটা অনেক সহজ হত। মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে ঘুরিয়ে নিতে পারলে বেশ হয়। আপসাইড ডাউন। আমি জল না তুলে জল যদি আমাকে তুলত! তেমন একটা শরীর পেলে দেখিয়ে দিতুম। এক বালতি তুলেই মনে হল, রোমেল যে-ধাতুতে তৈরি ছিলেন আমি সে ধাতুতে তৈরি হইনি। ব্যর্থ চেষ্টা। হেলে কখনও কেউটে হতে পারে না।
চৌবাচ্চার পাড়ে বসে একটু দম নিচ্ছি আর ভাবছি আর একটা ঘটনার কথা। বেশিদিন আগের নয়। দুপুরে পইতের মধ্যাহ্নভোজনে পঙক্তিতে বসেছি। পাশেই পিতাঠাকুর। আমরা একটু বেশি খাতিরের নিমন্ত্রিত। তাই আহার চলেছে কলাপাতা মাটির গেলাসে নয়। কাঁসার থালা, ধুম্বো কাঁসার গেলাস। তীষণ তেষ্টা। জলের গেলাস এত ভারী, যতবার চেষ্টা করি তুলতে আর পারি না। আঙুলে লেগে আছে তেল ঘি। মাটি থেকে সামান্য ওঠে আর ঠকাস করে পড়ে যায়। ভেবেছিলুম কেউ দেখছেন না। গৃহস্বামীর চোখ এড়াল না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, দাঁড়াও, আমি তুলে ধরি, তুমি খা। পিতাঠাকুরও দেখছিলেন আড়চোখে। তিনি বললেন, খবরদার, নো সাহায্য। নিজে তুলতে পারে খাবে, না হলে খাবে না। আচ্ছা, আমি তা হলে একটা হালকা গেলাসে জল এনে দিই। আজ্ঞে না। সমস্যাকে সহজ করে দেবার কোনও অধিকারই আপনার নেই। জীবন যখন যে-ভার কাঁধে চাপিয়ে দেবে সে ভার বইবার শক্তি অর্জন করতে হবে। এই বয়েসে ওই গেলাস তোলা উচিত। দিস ইজ এ ডিসগ্রেস। আহা! হাতে ঘি লেগে আছে যে! থাক না। সো হোয়াট! এই তো আমি তুলছি। আমার গেলাসটা তিনি বারকতক তুললেন আর নামালেন। এক, দুই, তিন। গৃহস্বামীকে বললেন, কিছু বলার আছে? বলার আর কী থাকতে পারে? অত ঝামেলা জানলে কে আর সাধ করে এগিয়ে আসত! তিনি এমন একটা মুখ করে চলে গেলেন, যেন, আপনার পাঠা আপনি বুঝুন! আমার কী?
আমি সেই পাঁঠা, রোমেল হবার ব্যর্থ চেষ্টায় পেট খামচে বসে আছি। দোতলার বারান্দা থেকে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন, কী হল কী তোমার? ওখানে লাট খাচ্ছ?
জীবনীকার লিখছেন, রোমেল মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন কিন্তু কখনও ঊর্ধ্বতনের কাছে গিয়ে নাকে কাঁদতেন না, আমার মাথা ঘুরছে, পেট ব্যথা করছে। সুতরাং উত্তর, না কিছু হয়নি তো!
তবে কি জৈন ধর্ম অবলম্বন করেছ? মশাকে রক্ত খিলাচ্ছ?
তেড়েফুঁড়ে উঠতে গিয়ে লাট খেয়ে পড়ে গেলুম। চেতনায় ভাসতে ভাসতে মনে হল মচকাব তবু ভাঙব না। তারপর আর কিছু মনে রইল না। কঠোর মানুষ যখন কোমল হন তখন একেবারে কুসুমের মতো হয়ে যান। সে প্রমাণ এ সংসারে মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়।