পিতৃদেব নাস্তিক, মাতামহ আস্তিক। মায়ের বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা জানা নেই। নাস্তিকের আর আস্তিকের রক্তে আমি বোধহয় এক জগাখিচুড়ি। পিতাঠাকুর বললেন, যাচ্ছ কোথায়? বিশ্বরহস্য খানিক শুনে যাও। স্বর্গ নেই নরকও নেই মানিক। আছে কেবল কর্ম। এ জন্মে যদি ভাল করে তন-মন-ধন হয়ে জ্যামিতি করো তা হলে আসছে জন্মে ইউক্লিড। যদি পদার্থবিদ্যায় মন দাও, পরের জন্মে বাথটব থেকে লাফিয়ে উঠে রাজপথ ধরে রাজবাড়ির দিকে ছুটবে ইউরেকা ইউরেকা করে। মাতামহ বললেন, ওই দেখো দেয়ালে ঝুলছেন জগদম্বা। ও মাগি যা করাবে তাই করতে হবে।
এ সব খেপা মেয়ের খেলা
যার মায়ায় ত্রিভুবন বিহ্বলা
সে যে আপনি খেপা, কর্তা খেপা, খেপা দুটো চেলা ॥
কী রূপ কী গুণভঙ্গি, কী ভাব কিছুই না যায় বলা
যার নাম করিয়ে কপাল পোড়ে, কণ্ঠে বিষের জ্বালা ॥
উতারো তানপুরা। লাগাও সুর। আহা, যেন ওঁকার ধ্বনি উঠছে চরাচর ব্যাপ্ত করে। উঁহু, ওভাবে বসলে চলবে না। বসতে হবে হাঁটু গেড়ে বজ্রাসনে। এখন সকাল। ধরো ভায়রো, মা মা রবে মনসুখে মন ত্রিতন্ত্রী একবার বাজা রে। মা মা বলবে অনেকটা সেঁকুর তোলার মতো করে। তলপেট থেকে ঠেলে উঠবে হৃদয়ের দিকে। কুলকুণ্ডলিনী চমকে চমকে উঠবে। একবার যদি জেগে যায়, আর পায় কে? নাও ধরো, মা মা রবে মনসুখে। মামা ঠিকই বলেছিলেন। আবেগে, বীরভাবে, রাগে দাদুর গলা ছেড়ে যে-জিনিস মুক্তি পেল, তাতে সুর নেই, ভায়রো, ভৈরবী, ধানেশ্রী, পুরিয়া, বেহাগ সব মিলে মিশে একাকার। দরদর করে জল ঝরছে দু’চোখ বেয়ে। এত অশ্রু কেন? ও গলার সঙ্গে আমি পারব কেন? মাঝে মাঝে চিঁহি চিঁহি করে মা রব ছাড়ছি। মূলাধার চমকে চমকে উঠছে কই! দাদু পাছে হার্টফেল করেন এই ভেবে নিজের হার্টই ধড়ফড় করছে। খালি হাত আকাশে বাতাসে কিছু একটা খামচে ধরার চেষ্টা করছে। উত্তাল সমুদ্রে জাহাজের মাস্তুলের মতো তানপুরা দুলছে সামনে, পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে। রাস্তার দিকের জানলায় সারি সারি কুচোকাঁচার মুখ। পথে চ্যাংড়া ছেলেরা ঘেউ ঘেউ করছে। দাদু মন ত্রিতন্ত্রীকে বাজাবার চেষ্টা করছেন। মহরমের হাসান হোসেনের মতো বুকে চাপড় মারছেন। তানপুরার পঞ্চমের তারটা পটাস করে ছিঁড়তেই দাদুর ভাবসমাধি হল। সমাধি ভাঙতেই জানলার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল খিস্তি করলেন। মুখের সারি ভেংচি কেটে সরে গেল। জগদম্বার ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, বেটি আজ খুব দিয়েছে। আমায় মাতিয়ে দে মা। আমি এমন করে মেতে যাই যেন এক মাতা হাতি!
চিঁ চিঁ করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না, বুঝেছ পান্তুরানি। সিংহের মতো ডাকতে হবে। নাদ ছাড়তে হবে। নাদ ব্রহ্ম। চিঁ চিঁ করে মেয়েছেলেকে ডাকা চলে, ওগো, শুনছ? দ্যাকো তো আমার পিটের এখানটায় যেন কী একটা কামড়েছে? এট্ট চুলকে দাও। ওই বেটিকে পেতে হলে পুরুষকার চাই। আয় মা রণে, দেখি মা হারে কি পুত্র হারে! এই বসলুম আসনে। দেহ শুকিয়ে ঝরে যাক, কুছ পরোয়া নেই, তুমি সামনে এসে না-দাঁড়ানো পর্যন্ত উঠছি না। সাধন করনা চাহি রে মনুয়া, ভজন লাগল ন্যাজের মতো। নট নড়নচড়ন। ব্যস, বাবু ফিনিশ। মৃত-স্ত্রী পিতারা বড় বেপরোয়া হন। শাসন করার কেউ থাকে না তো সংসারে! মা থাকলে সম্ভব হত কি ওই সুড়ঙ্গে ঢোকা! নাও এবার বোঝে ঠ্যালা! গোলমাল শুনে পাশের বাড়ির প্রবীণ মানুষ আশুবাবু দৌড়ে এলেন, কী হয়েছে বাবা?
মিস্ত্রী: বাবু ঘুঁষা।
প্রবীণ মানুষদের যে-কোনও জিনিসই বুঝতে বেশ দেরি হয়, কিন্তু একবার বুঝলে আর রক্ষা নেই। কে ঢুকেছে বাবা? তোমার বাবা? আজ্ঞে হ্যাঁ। পাতকোর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাবধানে উঁকি মারলেন। দড়ি ঝুলছে, মানুষ নেই। কিছুতেই বুঝতে পারেন না ব্যাপারটা কী? পাতকের মাঝামাঝি জায়গায় সুড়ঙ্গ? কোথায় এমন আছে? ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান ব্যাবিলনেই ছিল। একে রামে রক্ষে নেই, দোসর লক্ষণ। পাতকো বসাতেই ভিটেমাটি চাটি, মাঝে আবার সুড়ঙ্গ। কোন পাঁঠার কাজ? এমনভাবে তাকাতে লাগলেন যেন আমি এক রামছাগল! খুব বকাঝকা করে আশুবাবু সিদ্ধান্তে এলেন, তোমার বাবা প্রায়ই দুঃখ করেন, তুমি একটি অপদার্থ; এখন মনে হচ্ছে তোমার বাবা তোমার চেয়েও অপদার্থ। যাও, মা-টিকে তো খেয়েছ এখন বাবাটিও পাতাল প্রবেশ করলেন। নাও এবার গলায় কাছা নেবার ব্যবস্থা করো। আচ্ছা, দড়িটাকে একটু টেনে দেখলে হয় না?
কার সাহস হবে ওই দড়ি টেনে দেখার? আমার অত সাহস নেই। দড়ি ধরে টানলে যে-মানুষটি বেরোবেন তাকে আমি চিনি। আমি খ্যাকশেয়াল হলেও তিনি ব্যাঘ্র। সব জল্পনা কল্পনা থেমে গেল। ঝোলা দড়ি আরও খানিকটা ঝুলে গেল। ঝুলেছে ঝুলেছে বলে আশুবাবু কিঞ্চিৎ উল্লাস প্রকাশ করলেন। তোমার বাবা ব্যাক করছেন পিন্টু। অবশেষে একটি মুখ দেখা গেল। চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে সম্ভবত পিচ্ছিল পথে হড়কে হড়কে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। হাত নেড়ে বললেন, খিচো। সুড়ঙ্গ-মুক্ত পুরুষ মাঝামাবি: জায়গায় ঝুলতে ঝুলতে বললেন, ওয়ান্ডারফুল। এ গ্রেট ওয়র্ক অফ কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং।
ওপরে উঠে এলেন। হাতে একটা কী যেন রয়েছে। আশুবাবু উদগ্রীব, হ্যাঁগো, গুপ্তধন টুপ্তধন কিছু আছে নাকি? সংক্ষিপ্ত উত্তর, থাকলে আশ্চর্য হব না। আবার প্রশ্ন, হাতে ওটা কী? কচ্ছপের খোলা। বলো কী? তা হলে তো এ জায়গাটা দেখছি পীঠস্থান। কূর্মপীঠ। তা কতদূর গিয়েছিলে? মাইলখানেক হবে?