মুকু বললে, আমার রাগ আর অভিমান দুটোই হয়েছিল।
এখন?
এখন আর কিছু নেই।
আমি যা চাইছি তোমার মত আছে?
আছে।
তোমার বাবার মত?
কে বাবা? কার বাবা? আমার বাবা আমার সামনে বসে আছেন।
হরিশঙ্কর স্নিগ্ধ চোখে মুকুর দিকে তাকালেন। ভোরের নীল আকাশ অনেক সময় মানুষের দিকে এইভাবে তাকায়। ফাঁদে-পড়া ধেড়ে ইঁদুরের মতো আমার মনের অবস্থা।
ছোটদাদু বললেন, পিন্টু, এইবার তোমাকে প্রশ্ন, দেখলে তো অনেক, একই মশলার রকমভেদ, মুকুকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছ?
আমার মাথা অবনত। মুকু কি আমাকে মানুষ ভাবে! ওর চরিত্রের বলিষ্ঠতা আমার আছে কি? আমার সুরঞ্জনা, আমার জবা। আমার দুর্বলতার পরিধি তো কম নয়। আমি একটা ফড়িং। লাফ মেরে একবার এই ঝোপে, একবার ওই ঝোপে।
ছোটদাদু বললেন, উত্তর দাও।
আমি সব দিক থেকে ওর অযোগ্য।
আমি এই জ্ঞানোদয়টুকুই চেয়েছিলাম। যোগ্যের জন্যেই অযোগ্য। আচ্ছা শুরু করা যাক অনুষ্ঠান। একই মন্ত্রে দু’জনের দীক্ষা। মন্ত্রের জীবনবন্ধন।
অনুষ্ঠান শুরু হল। ছোটদাদু আচমন করে প্রত্যেকের হাতে একটু একটু গঙ্গাজল দিলেন। মন্ত্রটি ভারী সুন্দর,
হংস ঋষিঃ। অব্যক্তাং গায়ত্রী ছন্দ।
পরমহংস দেবতা। অহমিতি বীজম্।
স ইতি শক্তিঃ। সোহহমিতি কীলকম ॥
হরিশঙ্করের হাতে আমার ডান হাত, জয়নারায়ণের হাতে মুকুর ডান হাত। দু’জনে আমাদের হাত মেলালেন। ছোটদাদু লাল সুতোর সাতটা পাক মেরে বন্ধন দিলেন। সেই মিলিত হাতের ওপর শুরু হল তাঁর জপ। সময় চলে যায়। ধ্যান গভীর থেকে গভীরতর। একটা তরঙ্গ বহে চলেছে। শরীরে। একটা ঘোর। অদ্ভুত একটা ভালবাসার ভাব। একটা স্নিগ্ধতা। মুকুর আংটি চলে এল আমার আঙুলে, আমারটা মুকুর আঙুলে। ছোটদাদু কখন যে শাঁখা সিঁদুর জোগাড় করেছিলেন, তাও জানি না। আমাকে বললেন, শাঁখা পরাও, সিঁদুর দাও। ছোটদাদু বিশুদ্ধ উচ্চারণে বলছেন,
শক্তয়োহস্য জগৎ কৃৎস্ন শক্তিমাংস্তু মহেশ্বরঃ।
শক্তিস্ত শক্তিমনাদ ব্যতিরেকং ন গচ্ছতি।
তাদাত্ম মনয়োনিত্যং বহ্নি দাহি কয়োরিব ॥
ছোটদাদু বললেন, এইবার তোমরা দু’জনে আমাদের সাতবার প্রদক্ষিণ করে আসনে বোসো।
গোটা একটা মেয়ে আমার হাত ধরে গোল হয়ে ঘুরছে। মাথায় লাল ঘোমটা, হাতে শাখা, কপালে সিঁদুর। ধূপের ধোঁয়া, প্রদীপের শিখা। মন্ত্রের ওঙ্কার। ক্ষণিকের জন্যে মনে হল, এই ঘরের বাইরে তাঁবুর মতো বিশাল এক মশারির ভেতর একটি অসহায় পরিবারের অনিশ্চিত কাহিনি তৈরি হচ্ছে।
আসনে বসলুম দু’জনে। ছোটদাদু আমাদের কানে বীজমন্ত্র দিলেন। দিয়ে বললেন, কয়েকটি কথা স্মরণে রেখো। জীবনের পথে কাজে লাগবে। সুখে, দুঃখে, শান্তিতে, অশান্তিতে, সত্যকে হারিয়ে ফেলো না। উদার দৃষ্টিতে দেখবে। কখনও উৎকণ্ঠিত হবে না। বিপদে হারিয়ে ফেলো না নিজেকে। মনকে ধরে রাখবে কেন্দ্রবিন্দুতে, প্রদীপের স্থির শিখার মতো। মনকে শান্ত রাখবে, এক সেকেন্ডের জন্যেও দৃঢ়তা হারাবে না। মন হবে টলটলে তরল, নমনীয়, উদার, উন্মুক্ত, স্বাধীন। শরীর যখন বিশ্রামে তখনও মন যেন একাগ্রতা না হারায়। প্রচণ্ড ব্যস্ততা ও বিক্ষিপ্ততাতেও মাথা যেন ঠান্ডা ও স্থির থাকে। শরীর যেন মনের দ্বারা প্রভাবিত না হয়, মনও যেন শরীর নিরপেক্ষ থাকে। মনকে ধরে থাকবে, শরীরটাকে ভোলার চেষ্টা করবে। মনকে সবকিছু জানাবে, কিন্তু বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। বাইরের ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না, নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগাবার চেষ্টা করবে। ক্ষুদ্রকে বৃহতের ধারণা করতে হবে, বৃহৎকে ক্ষুদ্রের। সততাই একমাত্র মন্ত্র। জ্ঞানের পরিধি বাড়াও। জগতের সবকিছু জানো, বিচার, অবিচার সৎ, অসৎ। সমস্ত শিল্প ও দক্ষতা আয়ত্ত করো। পৃথিবী তোমাকে যেন ঠকাতে না পারে, যেন বোকা না বানাতে পারে।
ছোটদাদু হেসে বললেন, এইবার তোমরা গুরুজনদের একসঙ্গে প্রণাম করো।
প্রণাম শেষ হতেই বললেন, পুবের জানলার দিকে মুখ করে দু’জনে পাশাপাশি বোসো, মুকু বসবে তোমার বামে। তোমার বাঁ হাতের ওপর থাকবে মুকুর ডান হাত। ওই অবস্থায় একশো আটবার বীজমন্ত্র জপ করবে ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, একসঙ্গে। মনে মনে চিন্তা করবে, মন থেকে মনে চলে গেছে মন্ত্রের উজ্জ্বল একটি সেতু। একশো আট হয়ে যাওয়ার পর, মুকু বসবে তোমার কোলে। ওইভাবে একশো আট। তারপর তোমরা মিলিত হবে। শরীরে শরীর। ঊর্ধ্বে অধে, অধে ঊর্ধ্বে। কিন্তু, সঙ্গমের হি কর্তব্যং কর্তব্যং ন তু মৈথুন। আশা করি বুঝতে পারলে। আমরা চলে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ হচ্ছে বাইরে থেকে।
বন্ধ দুয়ার জীবের উপমা। বাইরেটা বন্ধ না হলে আত্মপ্রকাশ কী অসম্ভব! ওই দুয়ার যখন জগতের দিকে খুলে গেল আবার, তখন আর আমি নয়, আমরা দেখলুম, এক শান্ত সমাহিত সাধক, সাদা শার্ট, সাদা ধুতি পরে পথ ধরে হেঁটে চলেছেন, দূর থেকে দূরে। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না। যা ঘটে গেল, গেল। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। কৃষক যেভাবে জমিতে বীজ ছড়াতে ছড়াতে চলে যান দিগন্তের কোনও এক মহাবৃক্ষের আড়ালে। তারপর রাত আসে, মৃত্তিকার স্নেহে সময় খেলা করে যায়, দিবসের সূর্য শাসন করে, আরোপ করে তিতিক্ষা, আনন্দে উপ্ত হয় প্রাণ। চিতা জ্বলবে একের পর এক, সময়ের ব্যবধানে। সাক্ষী মহাকাল লিখবে জীবের কাহিনি, বাতাস উলটে যাবে পাণ্ডুলিপির পাতা।