ভোরের প্রথম পাখিটি কোথাও চিক করে উঠল, যেন দিনের কপাট অল্প একটু ফাঁক হল। ছোটদাদু মহানন্দে মশগুল। আমি ভাবছি, আর একটু পরেই এই আসর ভেঙে যাবে। এই মুহূর্তের সমন্বয় আর জীবনে ঘটবে না। সময় আর নদী একই ধারা। এক জল একই জায়গা দিয়ে দু’বার বহে যাবে না। অলওয়েজ নিউ, এভার চেঞ্জিং। ভাল লেগেছে বলে দৃশ্য ঘটনাকে আবার ইচ্ছামতো। সাজানো যাবে না। মালা হতে ফুলগুলি ছিঁড়ে ঝরে যায়।
হরিশঙ্কর বসে আছেন স্তব্ধ আকাশের মতো। ঘটনাকে মেনে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা তার। তিনি বলেন, মানুষ হল আইসক্রিম। খোলের ভেতর সময় ভরা। টসটস করে ঝরে যাচ্ছে মুহূর্ত। জীবন হল মোমবাতি জ্বলবে আর গলবে, নিঃশেষ একদিন। হরিশঙ্করের দর্শন হল, No one throws a stone at a barren tree. ফল ধরে আছে যে-গাছে, সেই গাছেই লোক ঢিল ছোড়ে। সফল জীবনই মানুষের আক্রমণের লক্ষ্য।
ছোটদাদু নড়েচড়ে বসে বললেন, এইবার তোমাদের অনুমতি ছাড়াই আমি একটা কাজ করব?
হরিশঙ্কর প্রশ্ন করলেন, কী কাজ! তুমি আবার অনুমতি নেবে কী, আমরাই তোমার অনুমতি নোব। বলো কী কাজ তুমি করতে চাও?
আমি একটা ব্রিজ তৈরি করব। ছোটদাদু হাসছেন।
সকলেই একটু অবাক। ব্রিজ তৈরি করবেন মানে? কোন নদীর ওপর?
হরিশঙ্কর বললেন, রহস্য কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হওয়া দরকার।
ছোটদাদু বললেন, পিন্টু, তোমার রাজবেশ পরে এসো। সিল্কের পাঞ্জাবি, গরদের ধুতি। পাঞ্জাবিতে সোনার বোম লাগাবে।
কেন ছোটদাদু?
আমি যে প্রশ্ন পছন্দ করি না পিন্টু।
আমার যে ওর কোনওটাই নেই।
তা হলে সাদা ধুতি আদ্দির পাঞ্জাবি পরে এসো।
জয়নারায়ণ বললেন, তোর না থাকে আমার আছে। যা পরে আয়, তোর দীক্ষা হবে। হালকা পালকের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। দীক্ষা মানে ত্রিজন্ম। উপনয়নে দ্বিজন্ম হয়ে গেছে। সেজেগুজে ঘরে ঢুকতেই ছোটদাদু বললেন, মুকু, তুমি একটা টকটকে লাল শাড়ি পরে এসো। লাল শাড়ি তোমার আছে, আমি দেখেছি।
জয়নারায়ণ বললেন, আমরাই বা কেন বাকি থাকি?
ছোটদাদু বললেন, ঠিকই তো। হরিকে নিয়ে যাও। বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে এসো। মুকু, তুমি দু’খানা পুজোর আসন, গঙ্গাজলের ঘটি, কোষা-কোষী, তাম্রকুণ্ড, ধূপ, ধূপদানি, দেশলাই, প্রদীপ নিয়ে আসবে।
একটা কিছু হবে, এই আনন্দে সব হয়ে গেল। পরিপাটি আয়োজন। ছোটদাদু আমাকে আর মুকুকে পাশাপাশি আসনে বসালেন। আমার বাঁ পাশে মুকু। প্রদীপ জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়া পাক খাচ্ছে ঊষার ফিকে গোলাপি আলোয়। আমাদের সামনে কোষা-কোষী, তাম্রকুণ্ড। ছোটদাদু বসেছেন সামনে পদ্মাসনে।
ছোটদাদু বললেন, জয়, তোমার আঙুলে দুটো আংটি। ও দুটো কি গ্রহশান্তির জন্যে?
আজ্ঞে না। শখের আংটি।
যে-কোনও একটার মায়া ছাড়তে পারবে?
কেন পারব না!
তা হলে মুকুর অনামিকায় একটা পরিয়ে দাও। পিন্টুর হাতে একটা রয়েছে দেখছি।
মাতুল মহা উৎসাহে মুকুর আঙুলে আংটি পরিয়ে দিলেন। বাইরে কলকল করে পাখি ডাকছে।
ছোটদাদু বললেন, ব্যাপারটা কী হতে চলেছে বলে তোমাদের অনুমান?
জয়নারায়ণ বললেন, দীক্ষা।
ছোটদাদু বললেন, না, দীক্ষা নয়, বিবাহ।
হরিশঙ্কর, জয়নারায়ণ দুজনে একসঙ্গে বললেন, বিয়ে!
আমার বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল। বিয়ে! এইভাবে কি বিয়ে হয়? বিয়ের তো কিছু নিয়ম আছে। তা ছাড়া মুকুর মতামত। হরিশঙ্করের ইচ্ছা অনিচ্ছা।
হরিশঙ্কর বললেন, পাত্রীর মত নিবি না? মুকুর বাবা?
ছোটদাদু বললেন, আমার মত, আমার ইচ্ছা। এর ওপর কারও কথা তো চলবে না।
হরিশঙ্কর বললেন, বিবাহের একটা অনুষ্ঠান আছে।
ছোটদাদু বললেন, সে দায়িত্ব আমার।
হরিশঙ্কর বললেন, বেশ, কিন্তু ছেলেটাকে এরই মধ্যে সংসারে ঢোকাবি! সংসার যে বড় কদর্য জায়গা। আমি চেয়েছিলুম ও হবে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। এক মুক্তপুরুষ।
ছোটদাদু একটা আঙুল তুলে বললেন, সন্ন্যাসী হওয়া কি ডাক্তার হওয়া, না ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। হব বললেই হওয়া যায়। সংস্কার চাই, দৈব কৃপা চাই। তুমি তো সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। ফিরে এলে ঘোর সংসারী হয়ে। কবে মুক্তি পাবে? আশার ছেলের মানুষ হতে পনেরো কুড়ি বছরের। ধাক্কা। এই পনেরোটা বছর তোমার কোনও মুক্তি নেই। সংসার! আমরা কে সংসারের বাইরে আছি হরিশঙ্কর? সংসার ঢুকে বসে আছে আমাদের মনে। পক্ষহীন শোনো বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ। পালাবার। জেনে রাখো, যৌবনের সকালেই তুমি তোমার স্ত্রীকে হারিয়েছ। এই বয়সে তোমার পুত্রবধূর প্রয়োজন, যাকে তুমি মা বলে ডাকবে। সেই ডাকাটাই তোমার সাধনা। পিন্টু আর মুকু, দু’জনের দুই গ্রহ। দু’জনের রাশিচক্রের মিলনে এই সংসার হেসে উঠবে। এর কিছু আছে, কিছু নেই, এর যা নেই ওর তা আছে, ওর যা নেই এর তা আছে। কীরকম জানো, একটা ছবি ছিঁড়ে দু’টুকরো। হয়ে আছে, এখন শুধু সাবধানে জুড়ে দেওয়া। কোনও পক্ষের কোনও প্রতিবাদ আছে?
কারও মুখে কোনও কথা নেই। নীরবতায় পেরেক ঠুকছে ঘরের দেয়ালঘড়ি। যেন কোনও স্বর্ণকার সময়ের অলংকারে মিছরি কাটছে।
ছোটদাদু বললেন, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। একটা প্রশ্ন কেবল মুকুকে, তোমার মন থেকে। পুলিশ অফিসারের সেই ছেলেটি ঝরে গেছে কি? সুরঞ্জনার দাদা?
মুকু চমকে উঠল।
ছোটদাদু বললেন, বিপজ্জনক জীবনসঙ্গী হত। ওদের পরিবারে তোমার সুখ হত না। ওদের আদর্শের সংজ্ঞা আলাদা। তুমি এই পরিবারের জন্যেই তৈরি।