হরিশঙ্কর হা হা করে হেসে বললেন, আরে এ তো চরম বেদান্তের গল্প। সুন্দর একটা অ্যালিগরি, অথরবাবা। সাপ আছে ব্যাংটার মনে, ব্যাংটার সংস্কারে। যুগ যুগ ধরে সাপ ব্যাং খায়। যেমন যুগ যুগ ধরে সংসার নামক ময়াল সাপ মানব নামক জীবকে গিলে বসে আছে। সংসার বলে কিছু নেই। কিন্তু আমাদের গিলে বসে আছে, এই অনুভূতি আমাদের সংস্কারে চলে গেছে। নড়তেও পারি না, চড়তেও পারি না, পড়ে আছি জবুথবু হয়ে। কী ঠিক বলেছি কি না!
ছোটদাদু বললেন, এই তো চাই হরিশঙ্কর! এমন একটা পরিষ্কার মাথা না হলে ধর্মের অধিকারী হওয়া যায় না। পিন্টু, আজ তোমাকে একটা কথা বলে যাই, সন্ন্যাসী আর গৃহীতে তফাত বিশেষ নেই। সন্ন্যাসীর মন যদি গৃহীর মন হয় তা হলে বাইরের গেরুয়া হল সাজমাত্র। মন না রাঙিয়ে কাপড় রাঙালে কী হবে যোগী! গৃহীও মন রাঙিয়ে যোগী হতে পারে। তোমার মাতামহ, মাতুল, তোমার পিতা সকলেই মহাসাধক। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। যে-কোনও ভেকধারী সন্ন্যাসীর কান কেটে দিতে পারে। কৌশলটা কী জানো, আরোপ করো। সেটা কী? একটা প্রতীকে তোমার মন স্থাপন করে। যেমন বৃক্ষ। সবসময় মনে করবে তুমি একটা বিশাল গাছ। সেই গাছে অসংখ্য পাতা। একটা দিন মানে অসংখ্য মুহূর্ত। কয়েক কোটি মুহূর্ত নিয়ে একটা দিন। একটা দিন মানে ষড়ঋতু। তোমার সকাল হল বসন্ত। মুকুলিত মুহূর্তের পত্রসম্ভার নিয়ে বৃক্ষরূপী তুমি দিন শুরু করলে। দ্বিপ্রহর হল গ্রীষ্ম। মধ্যাহ্নের দিন ঢলে যাওয়ার বিষণ্ণতায় বর্ষার অনুভূতি। অপরাজ্ঞের শরতে তুমি দিবসের ফসল তুলবে গোলায়। সন্ধ্যার হেমন্তে নামবে নির্জনতা। দিনের চোখ বুজে এল। যাত্রা করো, যাত্রা করো যাত্রীদল, পাখি ফিরে চলো কুলায়, ব্যস্ত জনপদ শান্তির কর্মবিরতির আচ্ছাদনে। রাত আসছে, আসছে শীত, আসছে জৈব-নিদ্রা। একে একে ঝরে গেল একটি দিনের সব মুহূর্তের পাতা। প্রতিটি মুহূর্ত যেন কারণে ঝরে। অকারণে নয়। কর্মের যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দাও তোমার ওই বিম্ববৃক্ষের এক-একটি ত্রিপত্র। ত্রিপত্র মানে, স্মরণ, মনন, নিদিধ্যাসন। বৃক্ষ অচল, বৃক্ষ অটল, সে শুধু ঊর্ধ্বে ওঠে, সসীম থেকে অসীমে যেতে চায়। আকাশে ডালপালা বিস্তার করে নৃত্য করে। পাখি হল রমতা সাধু। বৃক্ষকে সঙ্গ দেয়, ঈশ্বরের নাম শোনায়। আর বৃক্ষের ভূমি কী? সংস্কার। আর প্রাণরস কী? বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে তুমি আসবে কীভাবে? ধ্যানের মাধ্যমে। পুজোর চেয়ে জপ বড়, জপের চেয়ে ধ্যান বড়। নিক্তির ওপরের কাঁটা, নীচের কাঁটা। ওপরের কাঁটা হল ঈশ্বর-শক্তিতে বিশ্বাস আর নীচের কাঁটা হল মন। মাঝে মাঝে দেখে নাও, ওপরের কাঁটার সঙ্গে নীচের কাঁটা মিলেছে কিনা। যদি এদিক ওদিক হয়ে গিয়ে থাকে, বুঝতে হবে স্মরণে চলেছ, অবিশ্বাসে হেলেছ। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হও। চোখ বোজাও। বিচারে বোসো। ঝুঠা সোহাগ জগৎ কী রী সজনী, হোয় হোয় মিট জাসি/ মাতা পিতা সুত কুটুম কবীলা, টুটু গয়া জঁ তাগা। প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সোহাগ, পিতা, মাতা, আত্মীয়-কুটুম্ব সব দু’দিনের। ইন দেহকা গরব ন করনা, মাটিমে মিল জাসি/ এ সংসার চহরকি বাজি সাঁঝ পর্ভা উঠ জাসি। জগতের এই বিচিত্র রং-ঢং, কড়াক্রান্তি, গাড়ি-বাড়ি, সাজসজ্জা, যা কিছু দেখছ, এ সবই জাদুকরের জাদুখেলা। জীবনসন্ধ্যায় দেখবে সব ভোঁ-ভাঁ। জো দিন গয়ে সো ফির নহি আবৈ, অন্ত সময় কোই কামন আবৈ, জব জম লেহি বোলায়। জয়নারায়ণ, তোমার সেই বিখ্যাত গান :
আমার দিন তো চলে যায় মা,
আর কবে দেখা দিবি, ধুলা ঝেড়ে কোলে নিবি,
বড় দেরি হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি আয় মা ॥
জো দিন গয়ে সো ফির নহি আবৈ। আর শেষে যখন যম এসে ধরবে তখন কেউ আসবে না সাহায্য করতে। ইন দেহকা গরব ন করনা, মাটিমে মিল জাসি। এই হল বিচার। গানের চর্চা তো করো, তা এই গানটা গাইতে পারো? ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম। জয়, ধরো না। শেষ গানটা গেয়ে যাই। ধরো, গলা মেলাও।
জয়নারায়ণ বললেন, তা হলে হারমোনিয়মটাও আসুক। সুরে সুর লেগে যাক।
আমি উঠতে যাচ্ছিলুম, মুকু বললে, তুমি বোসো, আমি আনছি।
হারমোনিয়ম এসে গেল। শুরু হল গান। ছোটদাদু যেন ভাবসাগরে ভাসছেন। ক্ষীরের মতো চেহারা। পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত বসে থাকা। জয়নারায়ণ সুর ভাসালেন,
ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম।
আশার আশা ভাঙা দশা, প্রথমে পঞ্জুড়ি পেলাম।
প’বারো আঠারো যোলো, যুগে যুগে এলাম ভাল,
(শেষে) কচে বারো পেয়ে মাগো, পঞ্জা ছক্কায় বদ্ধ হলাম।
ছ-দুই-আট, ছ-চার-দশ কেউ নয় মা আমার বশ;
খেলাতে না পেলাম যশ, এবার বাজী ভোর হইল।
ছোটদাদু বললেন, জয়, রামপ্রসাদী তুমি এত ভাল গাও! চেহারা পালটে দিয়েছ। পঞ্জুড়ি মানে কী? পঞ্চভূত। পঞ্জা-ছক্কায় বন্দি হওয়া অর্থাৎ পঞ্চভূত ও ছয় রিপুর বশ হওয়া। ছ-তিননয়ে কঁকি দিব। ছয়কে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ ছয় রিপুর বশ না হওয়া। তিনকে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ তিন গুণের অতীত হওয়া। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ– এই তিন গুণেতেই মানুষকে বশ করেছে। তিন ভাই, সত্ত্ব থাকলে রজকে ডাকতে পারে, রজ থাকলে তমকে ডাকতে পারে। তিন গুণই চোর। তমোগুণে বিনাশ করে, রজোগুণে বদ্ধ করে, সত্ত্বগুণে বন্ধন খোলে বটে; কিন্তু ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না। কিন্তু পথ দেখিয়ে দেয়।