পিন্টু এর মানে কী? মন দেহেই বদ্ধ। দেহ ছেড়ে উড়তে পারে না, জানে না, অভ্যাস নেই। পারলে বলতে পারত হংসবলাকা কোথায় উড়ে যায়! জানতে পারত জীব কোথা হতে এসে কোথা ভেসে যায়। ছোটদাদু হঠাৎ ধ্যানস্থ। নীরব সরবতায় ঘর ভরে গেল। চাঁদ তুলে নিয়েছে লোটানো আঁচল। সূর্যসারথির স্বর্ণ ছায়ার মৃদু আভাস পূর্ব গবাক্ষে।
২.৫১ Thirty spokes will converge
রাত শেষ হয়ে এলে কেন আমার দুঃখ হয়! কেন হায় হায় করে ওঠে আমার ভেতরটা! হরিশঙ্কর, জয়নারায়ণ আমাকে এই উত্তরাধিকার দিয়েছেন। আমার মায়ের শরীরে যে-রক্ত ছিল, জয়নারায়ণের শরীরেও সেই রক্ত। তার সঙ্গে মিশেছে হরিশঙ্করের ধারা! হরিশঙ্করে মিলেছে। ছোটদাদুর বংশের বীজ। এঁরা সবাই নিশাচর। যত রাত বাড়ে, তত এঁদের আনন্দ বাড়ে, কর্মোদ্দীপনা বাড়ে। সবাই জেগে ওঠেন ভিন্ন এক জগতে। সে জগতে রহস্য, সে জগতের অন্য মাত্রা, অন্য বায়ু চলাচল। আকাশের ছায়াপথ নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে নেমে আসে, ভেসে আসে পরলোকের কণ্ঠস্বর, বিশাল বিশাল ভাব অতিথি হয়ে আসে, মনের ঝিনুক খুলে গড়িয়ে পড়ে চিন্তার মুক্তো। আমি যে এঁদেরই শরিক।
ছোটদাদু হঠাৎ সচেতন হলেন। নিজেকে গোটাতে চাইলেন একটি শ্লোকে,
কিমন্যৈরসদালাপেরায়ুষো যদ অসদ্ব্যয়ঃ।
মন্দস্য মন্দপ্রজ্ঞস্য বয়ো মন্দায়ুষশ্চ বৈ।
নিদ্রয়া হ্রিয়তে নক্তং দিবা চ ব্যর্থকর্মভিঃ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত থেকে বললেন ছোটদাদু। এই বংশের সমস্ত মানুষের অসাধারণ স্মৃতি। ছোটদাদু শৌনকের উপলব্ধিই ব্যক্ত করলেন, কী লাভ অযথা গালগল্পে। আয়ুক্ষয় ছাড়া তো অন্য কোনও ফল। হবে না। যারা অলস, যারা নির্বোধ, তাদের পরমায়ু এইভাবেই ক্ষয় হয়, রাতে ঘুম, দিনে বৃথা কর্ম।
ছোটদাদু কাঁচের টুকরোর মতো হাসলেন। হেসে বললেন, পিন্টু। জীবনে এমন কিছু আশা কোরো না যা তোমার আয়ত্তের বাইরে। সাধনজগতের একটা সত্য তোমাকে বলে যাই, এখানে জোর করে লড়াই করে কিছু পাওয়া যায় না। আপনি এসে ধরা দেয়। There is a treasure in the deep mountains; He who has no desire for it finds it. এ জগতে এক হাতে তালি বাজে, এক ডানাতে পাখি ওড়ে, এক পায়ে মানুষ চলে, একটা চোখে মানুষ দেখে। এ তোমার সোনার খনি দেখে এগোনো নয়, এগিয়ে সোনার খনি পাওয়া। এক কাঠুরে মাথায় এক বোঝা ডালপালা নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে যাও। পরের দিন সে সন্ন্যাসীর কথায় এগিয়ে গেল। দেখলে মোটা মোটা কাঠের জঙ্গল। সেদিন যতদূর পারলে কেটে এনে বাজারে বেচে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি পয়সা পেলে। পরের দিন আবার সে মনে মনে ভাবতে লাগল, তিনি আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন, ভাল, আজ আর একটু এগিয়ে দেখি না কেন? সে এগিয়ে গিয়ে চন্দনকাঠের বন দেখতে পেলে। সে সেই চন্দনকাঠ মাথায় করে নিয়ে বাজারে বেচে অনেক বেশি টাকা পেলে। পরদিন আবার মনে করলে, আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন। সে সেদিন আরও খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে তামার খনি দেখতে পেলে। সে তাতেও না ভুলে দিন দিন আরও যত এগিয়ে যেতে লাগলক্রমে ক্রমে রুপো, সোনা, হিরের খনি পেয়ে মহা ধনী হয় পড়ল। এই হল ধর্মের পথ। ভ্রমণকাহিনি পড়লে হবে না। সংকল্প নিয়ে, নির্দেশ মেনে এগোতে হবে। একটু-আধটু রূপ জ্যোতি দেখে বা সিদ্ধাই লাভ করে যে মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, সে মরেছে।
ছোটদাদু শব্দ করে হাসলেন। আমরা বসে আছি স্তব্ধ হয়ে। গলাটা একটু ধরাধরা লাগছে।
হরিশঙ্কর বললেন, ধর্ম ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কিছু নেই?
ছোটদাদু বললেন, অবশ্যই আছে। ভোগ আছে, দুর্ভোগ আছে। সাফল্য-অসাফল্য আছে। রোগ শোক জরা ব্যাধি আছে। ধর্ম হল বিচার। ধর্ম হল গণিত। ধর্ম হল হিসেব। ধর্ম হল ইনসেক্টিসাইড, পেস্টিসাইড। ধর্ম হল বুদ্ধি। লেজেগোবরে না হওয়ার কায়দা। বাঁচব, মরার সময় মরব। রোজ একবার করে মরব না। ধর্ম মানুষকে ঝকঝকে একটা জীবন দান করে। ধর্ম হল অলৌকিক এক টুথপেস্ট। মনের দাঁতকে ঝকঝকে করে। জীবনের দুর্গন্ধ দূর করে। ধর্ম নিয়ে ন্যাকামি চলে না,কাব্য চলে না। রোমান্টিকতা চলে না, ধর্ম হল কোদাল। মনের কৃষিকাজ ধর্মের কোদাল ছাড়া চলে না। হয় না।
হরিশঙ্কর বললেন, একটা জিনিস আমার মাথায় আসছে না, তোমার যদি মনেই হয় ক্যান্সার হয়েছে, তা হলে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ না করে, বিজ্ঞানের হাতে নিজেকে সমর্পণ করছ। না কেন! এটা কি একটা ন্যাকামি, একটা রোমান্টিকতা নয়?
ছোটদাদু হেসে বললেন, এটা আমার মনে হওয়া নয়, এটা ডাক্তারদের ডায়াগনোসিস। ক্যান্সার সারে না। চিকিৎসা মানে শরীরের ওপর অকারণ অত্যাচার আর টাকার শ্রাদ্ধ। বুদ্ধিমানের কাজ হল, চুপ করে বসে দেখো কী হয়! প্রেমিক হয়ে যাও। মৃত্যু-প্রেমিক। ধীরে ধীরে তাকে আসতে দাও। আমি ন্যাকা নই, রোমান্টিক ফুল নই, আমি বুদ্ধিমান। এ বিট ইনটেলিজেন্ট। ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ নয়, এ হল দুরারোগ্য ব্যাধির কাছে সারেন্ডার। ছোট জীবন সুখের, দীর্ঘজীবন দুঃখের। আমার কোথাও কোনও বন্ধন নেই। তোমাদের একটা হেঁয়ালি শোনাই। একটু। বোঝার চেষ্টা করো।
মনে করো একটা সাপ। এই মেঝেতেই শুয়ে আছে। সাপটা কপাত করে একটা ব্যাং গিলেছে। গেলার পর অলৌকিক কারণে সাপটা স্রেফ উবে গেল। সাপটার পেট যে জায়গায় ছিল মেঝেতে, দেখা গেল সেই জায়গায় ব্যাংটা বসে আছে হতভম্ব হয়ে, ব্যাংটা মরেনি। এইবার ওই ব্যাংটাকে বোঝার চেষ্টা করো। ব্যাং কী ভাবছে, তার মনের অবস্থাটা কী?