ঠাকুর কীভাবে জেনেছিলেন! মনকে যদি বিশ্বমন, চোখকে যদি বিশালের চোখ করা যায়, তা হলে সবই জানা যায়। একবার ঠাকুরের এক ভক্তের পালিতা কন্যার কলেরা হয়েছে। তিনি রামকৃষ্ণকে স্মরণ করছেন। ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত। অর্থাৎ শোনা যায়। বহু দূর থেকেও শোনা যায় ভক্তের কাতর ডাক। সে ডাক কান শোনে না, শোনে মন। তুমি যে-বিজ্ঞান জানতে চাইছ, সে বিজ্ঞান হল, মনের নিয়ন্ত্রণ। এদিকে কিছু করলে ওদিকে কিছু হয়। যেমন ঘটি মাজলে ঝকঝকে হয়, আয়নার কাঁচ পরিষ্কার করলে নিজের মুখ আরও পরিষ্কার দেখা যায়। যেমন গ্রামোফোনের স্টাইলাস পরিষ্কার করলে রেকর্ডের শব্দ আরও ঝনঝনে শোনায়। যেমন দূরবিনে চোখ রাখলে অনেক দূর দেখা যায়। এ-ও তাই। এর মধ্যে অলৌকিক যা, সেটা হল এক ধরনের জীবনযাপন। নাক বুজে থাকলে গন্ধ পাবে না, কানে খোল থাকলে শব্দ পাবে না। ব্যাপারটা হল খুলে দেওয়া, খুলে যাওয়া।
হরিশঙ্কর বললেন, ওপনিং আপ।
ছোটদাদু বললেন, এই বিজ্ঞান রবীন্দ্রনাথের সেই সুন্দর গানে একেবারে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে,
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে
দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি–পেয়েছি আঁধার রাতে ॥
না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো
তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে ॥
বৃষ্টিতে পড়ে থাকলে ভিজবে, রোদে ফেলে রাখলে পুড়বে, ফুলের বাগানে রাখলে সুগন্ধ পাবে, মাছের বেপারী হলে আঁশগন্ধ নেবে নাকে, সংসারে সংসারীর কোলাহল, মন্দিরে মন্ত্র, আরতির ঘন্টা, নিজেকে রাখা এইটাই হল বিজ্ঞান। মিনারে রাখলে আলো, বাতাস, দূরদর্শন, পাতালে অন্ধকার। কাকে রাখবে? দেহ নয়। এ বিজ্ঞানের সম্পর্ক দেহের সঙ্গে নয়, সে হল ভোগবিজ্ঞান, এ হল মনের ব্যাপার, মনোবিজ্ঞান।
প্রশ্ন করলুম, দামোদরের তীরের সেই গ্রামের পুকুরে আপনি যখন গভীর অন্ধকারে স্নান করতে যাচ্ছিলেন তখন আপনার পায়ের কাছে অলৌকিক আলো দেখেছি। সেটা কী?
আজ তুমি সবই জেনে নিতে চাইছ! তা নাও। আর তো তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না। আর আমার কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যাবে। কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
হরিশঙ্কর বললেন, তার মানে?
ছোটদাদু হাসলেন। গানের বাকি অংশটা শোনালেন,
এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানেগানে ॥
রাজার পথে লোক ছুটেছে, বেচা কেনার হাঁক উঠেছে
আমার ছুটি অবেলাতেই দিন-দুপুরের মধ্যখানে
কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তা কেইবা জানে ॥
হরিশঙ্কর অধৈর্য হয়ে বললেন, রহস্যটা কী?
রহস্য! এই পথে এক কাঁকড়া বিছে আছে। তার নাম কর্কট। শেষ সংগীত সেই লেখে। সে হল ঈশ্বরের দূত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কী হয়েছিল হরি?
হরিশঙ্কর কেমন যেন আতঙ্কিত হলেন, তার মানে ক্যান্সার! তোর ক্যান্সার হবে?
হবে কী! হয়ে আছে।
সেকী! আমরা জানি না!
জানালে তো জানবি! কাল, কাল কেন আজই বলি, ভোর তো হয়েই এল। আজ বেলা বারোটার সময় আমার স্বর বন্ধ হয়ে যাবে। আর ঠিক এক মাস পরে আমার স্বরনালী ফেটে যাবে। ইট উইল ওপন আপা আমি ধীরে নিঃশব্দে বিলীন হয়ে যাব মহাকালে।
জয়নারায়ণ বললেন, তা কী করে হয়? আমাদের ফেলে চলে যাবেন? আমরা চিকিৎসা করাব।
ছোটদাদু বললেন, কর্কটের কোনও চিকিৎসা নেই। সারেন্ডারই চিকিৎসা। শুনে রাখো, আজ এই ঘরে এই মুহূর্তে আমরা যারা বসেছি জলসায়, সকলেই ওই একই আশীর্বাদে দেহমুক্ত হব। তোমার হবে প্রসট্রেটে, হরির হবে ইসোফেগাসে, পিন্টুর হবে লিভারে, মুকুর হবে ব্লাডে। নদীর এপার থেকে একটি একটি করে খুলে যাবে তরী। আগে আর পরে। এই পথের এই পরিণতি, মন খারাপ কোরো না। মনে দুটো আকার যোগ করো, হয়ে যাবে মানা। মন, মান, মানো, মানা, এই হল ম-এর শব্দরূপ। এখন পিন্টুর প্রশ্নের উত্তর, শোনো পিন্টু, যোগ মানে নিজের শক্তিবলয়ের সঙ্গে সম্যক সংযোগ। যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে এই দেহভাণ্ডে। তুমি বসে আছ ভূমিতে। তোমার মাথার চাঁদি, তার পরেই আকাশ। এই তো তোমার বিস্তৃতি। আকাশ মানে অবকাশ মানে আভাস মানে অক্লেশ মানে অশেষ। গুহ্য থেকে মস্তক-শীর্ষ, সাতটি ভূমি। সপ্তভূমিতে সহস্রার। সেই সহস্রদলকমলে পরমশিব, পরমাত্মা। কুণ্ডলিনীদেবী সেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের বাসনায় সদা ছটফট করছেন। পিন্টু, রমণ বাইরে নেই, আছে জীবের ভেতরে। যোনি দেহনিম্নে নেই আছে দেহশীর্ষে। কুণ্ডলিনী দেবী কখনও ভেক, কখনও মীন, কখনও বা মর্কট গতিতে মূলাধার থেকে সহস্রারে উঠছেন, নামছেন। পরমশিব কুণ্ডলিনীশক্তির আশ্রয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে চাইছেন। দেখছেন চিদাকাশে বিবিধ নাম রূপ-বিশিষ্ট বিশ্ব বুদবুদের মতো ফুটছে ফাটছে। কখনও তিনি সচ্চিদানন্দ সাগরে লীন হয়ে যাচ্ছেন। পিন্টু, সাধন ছাড়া এই উপলব্ধি কথার কথা। রাজপথ বাইরে নেই আছে ভেতরে। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল এই ভেতরে। ভেতর থেকে বাইরে যেতে হয়। দু’জন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পাহাড়তলিতে হাঁটছেন। গুরু আর শিষ্য। হঠাৎ এক সার হাঁস উড়ে গেল। গুরু শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলেন, কী গেল? শিষ্য বললে, বুনো হাঁস। উড়ে যাচ্ছে কোথায়? শিষ্য বললে, প্রভু ওরা উড়ে চলে গেছে। গুরু সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যের নাক খামচে ধরে মোচড়াতে লাগলেন। শিষ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। গুরু বললেন, এই যে তুমি বললে উড়ে চলে গেছে। আমি দেখছি, শুরু থেকেই তারা এখানেই রয়েছে।