জয়নারায়ণ কানে কানে বললেন, অনাহত ধ্বনি।
আমরা সেই অপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি পাথরের মূর্তির মতো। এইসময় তো বিরক্ত করা উচিত হবে না। জয়নারায়ণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই বসে পড়লেন। আমিও বসে পড়লুম। বসেই মনে হল, যে ভূমিতে বসেছি সেটাও প্রসারিত সংকুচিত হচ্ছে। যেন বিশালের বুকের ওপর বসে আছি।
জয়নারায়ণ এই প্রলোভন থেকে আর সরে থাকতে পারলেন না। নাভির কাছ থেকে ওম বলে একটা শব্দ তুললেন। মাতুলের সুরের সঙ্গে ওঁদের সুর মিলে ঘরে এমন একটা রেজোনেন্স তৈরি হল ওপাশের টেবিলে রাখা কাঁচের সব জিনিসপত্র ঝনঝন করে উঠল। মনে হল আমার মাথাটায় ভেতর থেকে চিড় ধরে যাবে। বেলের মতো ফটাস করে ফেটে যাবে। আমার আধার অতি ক্ষুদ্র। গুড়গুড়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলুম। মরে যাব না তো! জয়নারায়ণকে আর কে পায়? নাভি উন্মোচিত হয়েছে। স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাচক্র ভেদ করে সহস্রারে ফেটে পড়ছে শব্দ। অদ্ভুত তার কম্পন। শরীর ঝিঁঝি পোকার মতো থিরথির করে কাঁপছে। জয়নারায়ণ সব ভুলে ভৈঁরোতে ধরলেন সেই বিখ্যাত গান :
মা মা রবে মন সুখে মন ত্রিতন্ত্রী বাজাও রে,
মায়ের রচিত সুমধুর বীণা বাজায়ে মা নাম গাও রে।
স্মরিয়ে ধূর্জটি মন্দ্র হতে উঠি, মধ্যগ্রামে যাও মন রে,
ক্রমে তারাপুরে উঠে তার স্বরে, তারা তারা ধ্বনি করো রে ॥
ভৈরবের অলৌকিক চলন। ষড়জ থেকে পঞ্চমে উঠে, কোমল মধ্যম শুদ্ধ গান্ধার কোমল ঋষভ স্পর্শ করে আবার ষড়জে নেমে আসছে। ঐশ্বরিক সুর লহরী। দুই যোগীর সাধন ভঙ্গ হল। তারা উঠে এলেন। বসে পড়লেন জয়নারায়ণের সামনে। জয়নারায়ণের কণ্ঠ ইস্পাতের ফলার মতো উদারা মুদারা তারায় অনায়াসে বিচরণ করছে। জয়নারায়ণ গাইছেন,
মিলায়ে অকার উকার মকার, মা নামের অগ্রে দিয়ে অলংকার
বাজাও সাধের বীণা বারবার, ভুবন কম্পিত করো রে।
মূলাধারে আছে নিদ্রিতা যোগিনী, নতমুখে সেই শিব সোহাগিনী,
তব বীণার ঝংকারে সুষুপ্তা দেবীরে, জাগায়ে প্রসন্না করো রে।
গঙ্গা যমুনা সরস্বতী ঘেরি, সার্ধ ত্রিকোটী তন্ত্রী সারি সারি,
বাজিছে নিয়ত মা মা করি, তব বীণার ভিতরে শুনো রে;
দীন রাম বলে মন কোরো নাকো হেলা, বাজাও সাধের বীণা এইবেলা
অজপা ফুরালে বীণা ফেলে যাবে আনন্দে আনন্দ নগরে।
ঝকঝকে মেঝে থেকে চাঁদের আলো ঠিকরে জয়নারায়ণের ঝিনুকের মতো মুখে পড়েছে। মনে হচ্ছে দেবতার মুখ। এক ফোঁটা, দুফোঁটা, জলের মুক্তোদানা গাল বেয়ে নামছে, যেন গাছের পাতা। ভোরের শিশির ঝরাচ্ছে। গান শেষ করে জয়নারায়ণ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ছোটদাদু তাঁকে। জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি মহাসাধক। এইবার তোমার সব চলে যাবে জয়, অর্থ, বিত্ত, ভোগ, দেহসুখ, থাকবে শুধু তোমার মাতৃনাম। জেনে নাও, এই তোমার শেষ জন্ম। তুমি হলে সুরলোকের। গান্ধার। রিক্ত হয়ে সুরের ভেলায় চড়ে চলে যাবে পূর্ণের কূলে।
জয়নারায়ণ বললেন, তাই হোক। তবে তাই হোক।
চন্দ্রালোকের ঘনত্ব কমছে। আগামী দিন জল ঢালতে শুরু করেছে দুধে। বিশ্বপ্রসবিনী এক আশ্চর্য কামধেনু। আমরা আমাদের উল্লাসে অন্যান্য ঘুমন্ত প্রাণীদের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। ধীরে দরজা খুলে মুকু এসে একপাশে বসল। শেষরাতের ঘুম-ভাঙা মেয়েদের দেখলে মনে হয় রাতের ট্রেনে বিদেশ যাচ্ছি সুখের সুটকেস নিয়ে। মুকুর আয়ত চোখে নিদ্রার তলানি। বাসি মুখ প্রসন্ন। শাড়ি নিভাজ নয়। গোল গোল ফরসা হাতে সোনার চুড়ির চেকনাই।
ঘোটদাদু বেশ আয়েশ করে বসেছেন খুশি খুশি মুখে। আসনে বসলেই এঁদের বিশ্রাম হয়ে যায়। হরিশঙ্কর প্রসন্ন। মনে হল এইবার কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে, এমন পরিবেশ, এই সুযোগ আর হয়তো আসবে না জীবনে। জানতে চাইলুম, কেমন করে একজন মানুষকে দেখেই তিনি তার। সম্পর্কে গড়গড় করে সবকিছু বলে যান? এর কি কোনও বিজ্ঞান আছে!
ছোটদাদুর মুখে হাসি খেলে গেল। বললেন, অবশ্যই আছে। প্র্যাকটিক্যাল সায়েন্স। করে পেতে হবে, অর্থাৎ কৃপা। শুদ্ধ, পবিত্র, নিষ্কাম জীবন যাপন করলেই এই শক্তি অর্জন করা যায়। অহংকার খুলে বেরিয়ে আসতে পারলেই যে-কোনও মানুষের জীবনে প্রবেশ করা যায়। অন্যের উনুনের ধোঁয়া যেভাবে বাড়িতে ঢোকে সেইভাবে তোমার মনও অন্যের মনে ঢুকে যেতে পারে। তুমি তখন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পাবে ছবির মতো। তা হলে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের একটি গল্প শোনো। মহাত্মা রামচন্দ্র দত্ত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তমণ্ডলীর একজন। একদিন তিনি চলেছেন দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুরকে দর্শন করবেন। শ্যামবাজারের পোলের কাছে ময়রার দোকান থেকে কয়েক পয়সার জিলিপি কিনেছেন। জিলিপি কিনে ঘোড়ার গাড়িতে উঠেছেন। গাড়ি ছাড়বে। কোথা থেকে ছ-সাত বছর বয়েসের এক মুসলমান ছেলে এসে বলছে, বাবু একটা জিলিপি। রামচন্দ্র কিছুতেই তাকে জিলিপি দেবেন না। জিলিপি কিনেছেন ঠাকুরের জন্যে। তাকে কেন দেবেন! গাড়ি চলতে শুরু করল। নাছোড়বান্দা ছেলেটি পেছন পেছন ছুটছে। হঠাৎ রামবাবুর মনে হল, এ হয়তো ভগবানের ছলনা। ভগবান পরীক্ষা করছেন। তার মনে পড়ে গেল সেই গল্পটি, এক সাধু রুটি তৈরি করে একটু ঘি আনতে গেছেন। এসে দেখেন, একটা কুকুর রুটি মুখে করে পালাচ্ছে। সাধু তার পেছন পেছন দৌড়োচ্ছেন আর বলছেন, রাম অপেক্ষা করো, রুটিগুলোয় ঘি মাখিয়ে দিই। মনে হওয়ামাত্রই রামবাবু একটা জিলিপি তুলে ছেলেটিকে ছুঁড়ে দিলেন। দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছে এই ঘটনা তিনি আর কাউকে বললেন না। বিকেলবেলা শ্রীরামকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করলেন, রাম, তুমি আমার জন্যে। কী এনেছ? রামবাবু ভয়ে ভয়ে জিলিপির ঠোঙাটি তার সামনে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুর। বাঁ হাতে জিলিপিগুলো চটকে হাত ধুয়ে ফেললেন। খেলেনও না, কিছু বললেন না। পরে একদিন রামবাবুর বন্ধুস্থানীয় একজনকে বলেছিলেন, ওদের সাবধান করে দিয়ো, দ্রব্যের অগ্রভাগ বেরিয়ে গেলে, সে জিনিস আর ঠাকুরের সেবায় ব্যবহার করা যায় না।