সেই মায়াময় দালানে অন্ধের মতো এক কিশোর টাল খাচ্ছে। পা লেগে গলা উঁচু মোরাবাদি ফুলদানি উলটে পড়েছে একপাশে। এই মাঝরাতে আমার পিসতুতো ভাই কী করতে চাইছে। দিগজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বলেই মনে হয়! নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে। সাবধানে দরজা খুলে এগিয়ে গেলুম।
কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলুম, কোথায় যাচ্ছ?
চমকে ফিরে তাকাল, ভয়ে ভয়ে বললে, আমি ছোট বাইরে করব।
ওদিকে নয়, বাথরুম এই দিকে।
ভাই বাথরুমে ঢুকেছে। পঁড়িয়ে আছি। দালানের একেবারে শেষ ঘরে চাপা গলায় দু’জনে কথা বলছেন। অনুচ্চ কণ্ঠে মন্ত্রপাঠের শব্দের মতো। যেন রাজকীয় দুটো ভোমরা ঘরে ঢুকে আছে। ভাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ পঁড়িয়ে রইলুম। রাতের অন্ধ পাখির মতো তার অনিশ্চিত ঘোরাফেরা মনে বড় দাগ ফেলে গেল। শীর্ণ এক কিশোর, সহায়-সম্বলহীন। আমাকে এই আঁধারে চালায় কে গো! এইরকম একটি সচল প্রশ্ন। বাইরে চাঁদের আলোর মুশায়েরা চলেছে। বৃক্ষ, লতা, গুল্ম অপ্সরার মতো বাতাসে নাচছে। নিস্তব্ধ চরাচর। মনে হচ্ছে, বৃহৎ এক স্বপ্নের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ঘুমের জগতেই জেগে উঠেছি অশরীরী হয়ে। পায়ে পায়ে এগোতে লাগলুম শব্দ লক্ষ করে। ঠাকুরদার অয়েল পেন্টিং যেন ফিসফিস করে ডাকলেন, পিন্টু! চললে কোথায়! নিদ নাহি আঁখিপাতে! আমি তো আপনাকে দেখিনি কোনওদিন, কিন্তু আপনি ওমনিপ্রেজেন্ট। যেখানেই যাই আপনার নাম।
দালানের শেষ ঘর। দরজার পাল্লা আধ-ভেজানো। দু’জনের কথা বলার শব্দ আরও স্পষ্ট। বাইরের দিকে তাকালুম, রুপোর আঁচল উড়িয়ে সুন্দরী রাত বিশ্বসভায় নাচছে। কোনও কবি কোথাও লিখছেন,
কাল চৌধভি কি রাত থি,
সফর রাহা, চর্যা তেরা
কুছ নে কহা ইয়ে চাঁদ হ্যায়,
কুছ নে কহা চেহেরা তেরা ॥
হরিশঙ্কর যথার্থই বলতেন, রাত কত রহস্যময়। যারা ঘুমিয়ে কাটায় তাদের মতো বঞ্চিত আর কেউ নেই। সমস্ত অপ্রাণ বস্তুও রাতে প্রাণ পায়। সামান্য একটা চেয়ার, দেয়াল, ছড়ি, বেড়ানোর ছবি, সব জীবন্ত। দূর থেকে একটা চেয়ারকে দেখো। শূন্য ঘর, শূন্য টেবিল, শূন্য চেয়ার, দেয়ালে পূর্বপুরুষের একটি ছবি। সেই ছবি থেকে নিঃশব্দে তিনি নেমে এলেন। চেয়ারে বসলেন। চারপাশে তাকালেন। হয়তো হাসলেন, নয়তো রাগত। অদৃশ্য কাগজে লিখে গেলেন, অদৃশ্য চিঠি। তোমরা ঠিক পথে চলছ না। আমি যা চাইনি, তোমরা ঠিক সেইটাই করছ। আমার ধারা তোমরা ঘুরিয়ে দিতে চাইছ। আদর্শ-ভ্রষ্ট হচ্ছ! কিংবা তিনি কোনও নির্দেশ দিলেন। ভয় পেয়ো না। সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকো। তোমাকে অপমান করেছে করুক, প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা কোরো না, তাতে তুমি নিজেই অপরাধী হবে। একা হয়ে যাবে। গডস জাস্টিস, ডিভাইন প্রোটেকশন আর পাবে না। অথবা লিখবেন, প্রিয়জনের অসুস্থতায় তুমি বিচলিত। অসহায় বোধ করছ? প্রার্থনা করো। নিজেকে বোঝাও, জন্ম, মৃত্যু তোমার হাতে নেই। ধৈর্য, সহ্য এই তোমার হাতিয়ার। বি কাম, বি পেশেন্ট, সারেন্ডার।
তিনি তোমার জন্যে সব লিখে যাবেন, দূরে দাঁড়িয়ে তুমি শুধু অনুভব করো। মধ্যরাতের নিথর বায়ুমণ্ডলে ভেসে আসছে ভিন্ন জগতের বার্তা। তুমি ধরার চেষ্টা করো। গুড সোল এই সময়ে ঘুরে বেড়ান তোমাকে সাহায্য করার জন্যে। শুদ্ধ মনে তুমি তা গ্রহণ করো। তোমার সেক্স, তোমার পারসেপশনকে অসীম করো। দেহসীমাকে লঙঘন করো। সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম হয়ে চেষ্টা করো আই অফ দি নিডল দিয়ে গলে যেতে। আদার ওয়ার্লডে যাওয়ার পথ ভারী সূক্ষ্ম। পথ আছে। সেটা স্থূল নয়। ভেরি মাইক্রসকোপিক। চেষ্টা করতে হবে, আঁকুপাঁকু করতে হবে। এই জগতের নিয়মে সে জগৎ চলে না। সেখানে টাইম সাইকল ভিন্ন। সেখানে গ্রাভিটি নেই। সে জলে লোহা ভাসে, শোলা ডুবে যায়। হরিশঙ্কর এমারসনকে উদ্ধৃত করবেন, Great men are they who see that spiritual is stronger than any material force, that thoughts rule the world.
হঠাৎ পেছনে একটা খসখস শব্দ হল। ভয়ে চমকে উঠেছি। সাদা একটা মূর্তি। মাতুল জয়নারায়ণ। কাছে এসে চাপা স্বরে বললেন, কী রে, চোর পালিয়েছে?
চোর নয়, পিসতুতো ভাই।
তা তুই এখানে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন চাঁদের আলোয়! জানিস না চাঁদের আলোয় অ্যানিমিয়া হয়। ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় বোঝাতে চাইলুম, চুপ করুন।
কানের কাছে মুখ এনে বললেন, কেন রে?
ঘরের ভেতর গুঞ্জন।
মাতুল শুনলেন। বললেন, চল না যাই। কেন বঞ্চিত হব চরণে!
দরজাটা ধীরে খোলা হল। ভেতরটা প্রথমেই দেখা গেল না। ডান দিক থেকে একটা দেয়াল দরজার দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। তৈরি করেছে বড় মাপের একটা খাঁজ। সেই অংশে হরিশঙ্করের নিজস্ব ল্যাবরেটরি। লম্বা একটা টেবিল। অ্যালুমিনিয়ামের পাত মোড়া। টেস্টটিউব, ফ্লাস্ক, জার, ব্যুরেট, ডিক্যান্টার, ডিস্টিলেশন ফ্লাস্ক, স্পিরিট বার্নার, কেমিক্যালস, রিজেন্ট বটল, ছোট একটা হাপর। রাতের পর রাত এখানে কাজ চলে। ভেষজ কিছু একটা তৈরি করতে চাইছেন। একটা আমি জানি, দুরারোগ্য একজিমার ওষুধ।
বাঁ দিকে ঘুরতেই ঘরের ভেতরটা দেখা গেল। জানলার দিকে মুখ করে মেঝেতে আসন পেতে পাশাপাশি বসে আছেন ছোটদাদু আর হরিশঙ্কর। দুধের মতো চাঁদের আলোয় দু’জনে ভাসছেন। দু’জনের নাভির কাছ থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ উঠছে। ওঙ্কারের সঙ্গে আরও কিছু জড়িয়ে আছে। সেই শব্দে আমার বুকের কাছটা কাঁপছে, রোম খাড়া হয়ে উঠছে।