কড়িকাঠের দিকে তাকাও, নেমে যাবে।
ছোটদাদু আমার আর একপাশে। তিনি বললেন, বলেছ ভাল। ওপর দিকে তাকালে সব বাধা সরে যায়।
.
মুকু একটা জায়গান্টিক বিছানা তৈরি করেছে। দেখার মতো। সেই বিশাল মশারি। পিসিমার পুরো পরিবার সেই মশারির ভেতর। পিসিমার ছোট মেয়ে হঠাৎ ফোঁস ফোঁস করে কান্না শুরু করল। পিসিমা বললেন, শুরু হল। কঁদছিস কেন? বলবি তো কী হয়েছে। কী বলবে? ওই বালিকার গুছিয়ে বলার ভাষা আছে কি? একটা সংসার চুরমার হয়ে যাওয়ার বেদনা। একটা গ্রাম, চেনা পরিবেশ, পরিচিত জীবন ছেড়ে আসার বেদনা। শিকড়সুদ্ধ তুলে এনে ভিন্ন এক মাটিতে বসিয়ে দেওয়া। মুকু মেয়েটিকে কোলের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। সে তখন স্বপ্ন দেখছে সবুজ মাঠ, একটি ছাগলছানা, ছাতা বগলে পণ্ডিতমশাই, যত খেলার সাথী। দূর থেকে ভেসে আসছে কিশোরীকণ্ঠের ডাক– উষি।
২.৫০ The flowers fall for all our yearning
মাতুল জয়নারায়ণ আর আমি একই বিছানায়। মুকু মশারি ফেলে গুঁজে দিয়ে গেছে। শৌখিন জয়নারায়ণের জন্যে বিছানাটাকে যতদূর সম্ভব পরিপাটি করেছে। বালিশে পরিচ্ছন্ন তোয়ালের ঢাকা। মাথার কাছে একটা টুলে চাপা দিয়ে গেছে এক গেলাস জল। ছোট একটা পেতলের পদ্মকাটা বাটিতে লবঙ্গ, বড় এলাচ। মাঝরাতে জয়নারায়ণের কাশি হয়; তখন প্রয়োজন হতে পারে। মুকুর নজর সব দিকে।
বিছানায় আমরা দুজনে গড়াচ্ছি, বাইরে গড়াচ্ছে রাত। রাতের ভেলায় ভেসে চলেছে জীবজগৎ, নতুন দিনের কূলে। দু’জনেই চিত।
মাতুল জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোন পাশে শুস?
সাধারণত বাঁ পাশে।
ধনুক হয়ে যাস?
না, স্ট্রেট।
তোর নাক ডাকে?
মনে হয় না।
আমার নাকে এফ শার্পে তারার সা বাজে, সিসি করে। তখন আমাকে ঠেলে দিবি।
আমি তো এখনই ঘুমিয়ে পড়ব মামা।
হাই পিচ সাউন্ডে তোর যদি ঘুম ভেঙে যায় তা হলে আমাকে ঠেলে দিবি। জানিস তো, সারারাত আমি গান গাই। স্বপ্নে। বিশাল বিশাল সব আসর। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন। এপাশে ওপাশে জাফরির কাজ। চারটে তানপুরা, সুরমণ্ডল, তবলায় আল্লারাখা, সারেঙ্গিতে লজ্জন খান, চারপাশে সমঝদার শ্রোতা। ধরেছি মারুবেহাগ।
মাতুল হঠাৎ একটা ইংরেজি কবিতা ধরলেন।
There they stand, the innumerable stars,
Shinning in order like a living hymn, written in light.
নীরব রইলেন কিছুক্ষণ। ফরসা কপালে আলতো পড়ে আছে বাঁ হাত। পূর্ণ চন্দ্রের আলো মাথার কাছের জানলা দিয়ে মুখে এসে পড়েছে। জয়নারায়ণকে অবিকল কবি কিটসের মতো দেখতে। দুধসাদা একটা ধুতি দু’ভাজ করে লুঙ্গির মতো পরেছেন। ধবধবে সাদা গেঞ্জি। শরীরের ত্বক এত পাতলা যে ছোট ছোট শিরা আর ধমনীর রক্তস্রোত গোলাপি আভা ছাড়ে। খুব সাবধানে সংগ্রহে রাখার মতো একজন পরিপূর্ণ শিল্পী।
মাতুল আপন মনে গুনগুন করে খাম্বাজ আলাপ করতে লাগলেন। আমি জেগে থাকার অনেক চেষ্টা করেও একসময় ঘুমিয়ে পড়লুম। কতক্ষণ নিদ্রায় পাথরের একটা বাটির মতো তলিয়ে ছিলুম জানি না। হঠাৎ একটা ধাতব শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। যেন পেল্লায় এক ঘড়ি বাজল কোথাও। শব্দটা মনে হয় পাশের ঘরে হল। মাতুল ধারে শুয়েছিলেন, আমি দেয়ালের দিকে। অনেকক্ষণ হিসেব করলুম, অতল নিদ্রায় শান্ত শোলার মতো একটি মানুষকে না জাগিয়ে কীভাবে ভূতলে অবতীর্ণ হওয়া যায়! টপকাতে হবে। সাবধানে পায়ের ওপর দিয়ে শরীর স্পর্শ না করে মেঝেতে নেমে মশারিটা আবার খুঁজছি, জয়নারায়ণ বললেন, একটা কিছু হাতে নিয়ে বেরোও, চোর হতে পারে! জয়নারায়ণ নিদ্রা আর জাগ্রত অবস্থার পাতলা স্তরে অবস্থান করছিলেন, পা ডোবে না এমন জলে নৌকো বাওয়ার মতো। চোরের ভয় ধরিয়ে দিলেন। মুহূর্তের জন্য থমকে যেতে হল। অতীতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। চোরের সঙ্গে শুভদৃষ্টি বিনিময়। চোর পঁড়িয়ে আছে জানলার শার্সির বাইরে, আমি ঘরে। দু’জনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। প্রথমে আমি ভেবেছিলুম, ওটা আমারই প্রতিবিম্ব। হঠাৎ খেয়াল হল তা কী করে হয়! আমার নাক তো অমন নয়। আমার ভুরু আছে, প্রতিবিম্বের ভুরু নেই। রং কালো। চোখদুটো মরামরা। ওটা তো আমি নই। তখনই আমি চোর চোর বলে চিৎকার করলুম চোর লজ্জায়, আমার ভয় পাওয়ায় লজ্জায় দোতলার কার্নিস থেকে এক লাফ মেরে একতলায় পড়ে পাঁচিল টপকে ছুটে পালাল। চোরের দোষ কেউ দিলে না, সকলে আমাকেই তিরস্কার করতে লাগল, তুই চিৎকার করলি কেন ইডিয়েট! চোর এলে নিজে চোর হতে হয়। পা টিপে টিপে পেছন দিক থেকে গিয়ে জাপটে ধরতে হয়। ধরেছি প্রভু! আর তোমাকে ছাড়ব না। যত বলি, কার্নিসের তো পেছন নেই। তার সবটাই তো সামনে। কেউ মানতে চায় না। তখন বললে, তা হলে নেমে গিয়ে লুফে নিলে না কেন! চোর যেন ক্রিকেট বল! ওভার বাউন্ডারির মারে আসছিল, ব্রাডম্যানের মতো ক্যাচ করব আমি। সিদ্ধান্ত হল, আমার মতো ভিতু এর চেয়ে আর কী করতে পারে!
দরজা খুলছি, জয়নারায়ণ বললেন, আগেই ঝট করে বেরোসনি। মাথাটা এগিয়ে দিয়ে বাইরেটা দেখে নে। কত বড় চোর। ধরার শক্তি তোর আছে কি না! চোর ধরা প্রায় মাছ ধরার মতোই।
বাইরের দালান চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। রুপোর তবক মোড়া। দেয়ালে ঠাকুরদার অয়েল পেন্টিং চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রে রহস্যমণ্ডিত হয়ে জীবন্ত। ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে আসীন গম্ভীর এক পুরুষ। হাতে আড়াআড়ি একটি ছড়ি। সেকালের সুখ্যাত প্রখ্যাত এক শিক্ষক। একালে তাঁর জীবিত ছাত্ররা শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন। তাঁর পৌত্র বলে অযাচিত স্নেহ করেন।