.
একপাশে বসে বসে ঢুলছিলুম। মুকু এসে বললে, তুমি আগে খেয়ে শুয়ে পড়ো না! তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে।
শুয়ে পড়লে বাবা বকবেন। আর শোবই বা কোথায়? এতগুলো মানুষের বিছানার কী ব্যবস্থা হবে? ক’টা মশারি লাগবে জানো?
সে ভাবনা তোমার নয়, আমার। তোমাকে যা বলছি তাই করো। তোমাকে ভূতের মতো কাহিল দেখাচ্ছে।
মুকুর কী উপমা! ভূতের মতো কাহিল! মুকুকে একেবারে গার্ডেন-ফ্রেশ দেখাচ্ছে। শিশির-ভেজা গোলাপের মত। টুসটুসে গাল, টসটসে ঠোঁট। আকাশি রঙের শাড়ি। মুকুর নিজস্ব একটা সুগন্ধ আছে, লিলিফুলের মতো। আজ যদি কেউ কোথাও না থাকত, তা হলে মুকুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তুম, সাবিত্রীর কোলে সত্যবানের মতো। অরণ্যের গল্প বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়তুম। স্বপ্ন দেখতুম, দামোদরের কূল ছাপিয়ে বান আসছে। প্রতিমুহূর্তে মানুষের প্রায় প্রতিটি ইচ্ছারই মৃত্যু হয়। মন হল ইচ্ছার মহাশ্মশান। মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে মুকুর গোল কবজিটা ধরি। বুকের কাছে মাথাটা একটু রাখি। উপায় নেই, একটা ছেলে একটা মেয়ে, সংসারের যত পাপের উৎস! লেবরেটরিতে আমরা যেরকম কালচার প্লেট তৈরি করি, এক জীবাণুর সঙ্গে আর এক জীবাণুকে মিলিয়ে, ছেলে আর মেয়ে সেইরকম পাপের কালচার প্লেট।
এই ঘোর বেশিক্ষণ স্থায়ী করা গেল না, ওঘর থেকে হরিশঙ্করের ডাক এল, প্লিজ হেলপ মি। ছোটদাদু তার সেই অসাধারণ লাল সিল্কের লুঙ্গি পরে অনাবৃত ঊর্ধ্ব-দেহে বসে আছেন মহাযযাগী। প্রশস্ত ফরসা বুকে স্ফটিকের মালা শীতল আগুনের মতো খণ্ড-শোভা ধরেছে। হরিশঙ্কর আমাদের সেই বিখ্যাত মর্গের পাল্লা খুলেছেন। একটা আলমারি। ছোট একটা ঘরই বলা চলে। জয়নারায়ণ ধরে আছেন টর্চ।
হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের সেই উৎসবের মশারিটা বের করতে হবে।
তাঁবুর মতো বিশাল তার আকৃতি। ভেতরে দশ-বারোজন স্বচ্ছন্দে সিধিয়ে যেতে পারে। হরিশঙ্কর পরিকল্পনামতো তৈরি করিয়েছিলেন। মশার উৎপাতে জর্জরিত। সন্ধের পর চলতে গেলে ধাক্কা লাগে। মাথায় খেলল মশারি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘর হবে। ঘরের অন্তর্বাস। তার ভেতর চেয়ার, টেবিল, যাবতীয় আয়োজন। পড়া তো যাবেই, তেমন হলে খানা খেতেও অসুবিধে হবে না। চাটনি আর গুড় তো খাওয়ার উপায় নেই। চাটনিতে মশার আত্মবলি, গুড় হল মশার কদমা। পরিকল্পনা। মতো চলেছিল বেশ কিছুদিন। বাধ সাধলে আমাদের প্রিয় বেড়াল। মশারির গা বেয়ে চড়চড়িয়ে চালে গিয়ে ওঠে। চাল ঝুলে গেল। সেখানে সার্কাসকুমারীর মতো তার হরেক কসরত। লেখাপড়া তো মাথায় উঠলই। মশারিরও অস্ত্রোপচার। সে যে কী নিদারুণ দুষ্টুমি, অথচ কী সুইট!
সেই গ্রাম-বিশেষ মশারির সন্ধানে একদিক থেকে আমি, একদিক থেকে মুকু অ্যাডভেঞ্চারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম।
আমি ভয় করব না ভয়, করব না। দু’বেলা মরার আগে…।
জয়নারায়ণ বললেন, এর তো আলাদা একটা মৌজা, দাগনম্বর, খতিয়ান নম্বর থাকা উচিত, আলাদা পোস্টাপিস! আচ্ছা চাটুজ্যেমশাই, আর ইউ শিয়োর, যে এর মধ্যে অন্য আর কোনও প্রাণীর বসবাস নেই, যেমন ধরুন আরশোলা?
হরিশঙ্কর বললেন, আরশোলাকে আমি প্রাণী বলেই গণ্য করি না। ও আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ভয় হল ইঁদুর।
জয়নারায়ণ একটু পিছিয়ে গেলেন। বলতে লাগলেন, সাবধান! সাবধান! লাফ না মারে।
হরিশঙ্কর বললেন, ওদের সাবধান করার আগে নিজের পালাবার পথটা দেখে রাখো। জয়, তুমি যদি কোনও আর্মির জেনারেল হতে তা হলে কী দশা হত!
চাটুজ্যেমশাই, ছোটখাটো প্রাণীকেই আমি একটু সমীহ করি। বড়দের আমি ভয় পাই না। আপনি একটা বাঘ আনুন, আমি মালকোষ মেরে ঠান্ডা করে দেব।
এদিকে লেপ কম্বল, বাড়তি বালিশের তূপে আমাদের দধিমন্থন চলেছে। সাদামতো গোল গোল গোটাকতক কী পুটপুট করে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গেল। মাতুল লপ্রদান করে বললেন, গোখরো সাপের ডিম।
হরিশঙ্কর বললেন, আই অ্যাম সরি জয়। ওগুলো ন্যাপথলিনের বল।
শব্দ করে একটা পিতলের পিলসুজ মেঝেতে পড়ে কিছুদূর গড়াল। জয়নারায়ণ বললেন, শব্দটা শুনলেন চাটুজ্যেমশাই! পারফেক্ট পঞ্চমে স্টার্ট করে গান্ধার ছুঁয়ে নেমে গেল, বিশুদ্ধ ভূপালী।
হরিশঙ্কর বললেন, ওইজন্যেই তোমাকে ভালবাসি জয়। সংগীত তোমার ধ্যানজ্ঞান। সত্যিই তুমি গন্ধর্ব। বহুত হাঁটকাহাঁটকির পর সেই মশারির গোলা বেরোল। হরিশঙ্কর বললেন, সাবধানে খোলো। দু-চারটে আরশোলা বেরোতে পারে।
আরশোলা নয় কিছু উচ্চিংড়ে পুটপাট লাফিয়ে এদিক ওদিকে চলে গেল। সেই তালে মাতুল একটু নাচানাচি করলেন। হরিশঙ্কর বললেন, জয়, তোমার নাচের দক্ষতাও অস্বীকার করা যায় না। এটা ন্যাচারাল, না শিখেছিলে?
জয়নারায়ণ বললেন, আজ্ঞে আরসোলাই আমার গুরু। সেই ছেলেবেলা থেকেই তালিম দিয়ে আসছে। এটা যা দেখলেন, ককরোচ ড্যানস।
অনেকটা কথাকলির মতো।
সেই রাতে বারান্দায় বিশাল পঙক্তি ভোজ। পরপর বসে গেছি। জয়নারায়ণ বললেন, বেশ বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি লাগছে।
আমার পাশে আমার পিসতুতো ভাই। চুপিচুপি বললে, এরা জল দেবে না?
চুপিচুপি বললুম, এদের নিয়ম খেতে বসে জল না খাওয়া। কড়া নিয়ম। খাওয়ার পাতে জল খেলে হজমশক্তি কমে যায়। গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড ডাইলুট হয়ে যায়। অম্বলের ব্যায়রাম হয়।
আমার যে গলায় আটকে যাচ্ছে।