ছোটদাদু তাকে টেনে নিয়ে গেলেন একপাশে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হল দু’জনে অন্তরঙ্গ ভাবে।
রাজসমারোহে আমরা ট্রেনে চাপলুম। এইবার ছোটদাদু আমার পাশে। উলটোদিকে হরিশঙ্কর। হরিশঙ্করকে আমরা এমনভাবে ঘিরে রেখেছি যাতে আর কোনও গোলযোগ না হয়। ট্রেন অবশ্য খুবই ফাঁকা।
ছোটদাদু বললেন, ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল।
কেন? মনখারাপ কেন?
অত সুন্দর ছেলে, কিন্তু বাঁচবে না বেশিদিন।
কে? ওই ড্রাইভার?
হ্যাঁ। খুব সামান্য আয়ু হাতে নিয়ে এসেছে।
আপনি পারেন না বাড়াতে?
ওই একটা জায়গায় কেরামতি চলে না পিন্টু।
বিধ্বস্ত সৈন্যবাহিনীর মতো আমরা একটা দল পাড়ায় ঢুকলুম। আমাদের বিশ্বস্ত দুই অভিভাবক, দুটো কুকুর মোহর আর পন্টু, মাঝরাস্তাতেই ধরে ফেলল আমাদের। তাদের সে কী নর্তন কুর্দন! হরিশঙ্কর ছোটদাদু দু’জনেই এদের ভক্ত। সকাল বিকেল দুপুর ভোজনের অন্ত নেই। তন্ত্রের সঙ্গে কুকুরের গভীর যোগ। হরিশঙ্কর জীবজন্তুপ্রেমী। গাড়ি চাপায় মোহরের ঠ্যাং ভেঙেছিল, হরিশঙ্কর প্ল্যাস্টার করেছিলেন। সকলের চিৎকার, কামড়ালেই জলাতঙ্ক। হরিশঙ্কর বলেছিলেন একটি কথা, মোহর মানুষ নয়। সবাই ঠোঁট উলটেছিল। বলেছিল, কামড়ালেই বুঝবেন মোহর মানুষ না কুকুর! হরিশঙ্করের হাতে ছোট একখণ্ড কাঠ, প্ল্যাস্টার অফ প্যারিসের টিন, ব্যান্ডেজ। তিনবার টুসকি মেরে মোহরের সামনে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল মোহরের কান্না। মোহর লেজ নাড়ছে। হরিশঙ্কর নিপুণ একটি প্ল্যাস্টার করে উঠে দাঁড়ালেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই।
একটা স্টেশনারি দোকান তখনও খোলা ছিল। ছোটদাদু একগাদা বিস্কুট কিনলেন। বাড়ির সামনে এসে রকের ওপর বিস্কুটগুলো ছড়িয়ে দিলেন। মোহর আর পন্টুর ভোজন শুরু হল। পন্টু মোহরের ছেলে। খাওয়ার আগে দু’জনেই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাদের বিখ্যাত সেই উল্লাসের ডাকটি ছাড়ল।
কানে আসছে গান। মাতুল জয়নারায়ণ দোতলায় গান ধরেছেন,
পড়িয়ে ঘোর সংকটে ডাকি তোমায় অকপটে।
নিকটে বারেক আসি দাঁড়াও না।
পক্ষ হইয়ে বিপক্ষ, প্রতিপলে করে লক্ষ, দিতেছে দারুণ মন বেদনা।
দুটি খুঁটির উপরে, দিয়াছ রহিতে ঘরে, ঘুণ ধরে সে যে আর থাকে না।
সুরটা মনে হচ্ছে খট। আমার মাতামহের কণ্ঠে শুনেছি এই গান, রাম দত্তের লেখা। আমাদের বিখ্যাত সদরের কালোয়াতি দরজা খোলাই ছিল। ঠেলতেই হড়াস হয়ে গেল। তিন ভঁজ দরজা পৃথিবীর কোথাও আছে কি? একমাত্র এই বাড়িতে।
সিঁড়ির মাথায় প্রথমেই দেখা হল মুকুর সঙ্গে। আনন্দের উল্লাস, আপনারা এসেছেন?
আরও কিছু বলত, পিসিমাদের দেখে থমকে গেল। জড়োসড়ো হয়ে উঠে আসছে চারটি প্রাণী।
পিসিমার মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। এটা পিসির নিজের বাড়ি, তবু কী সংকোচ!
জয়নারায়ণ বেরিয়ে এলেন গান থামিয়ে। পরিবেশ বদলে গেল। জয়নারায়ণ হইহই করে বললেন, আশাদি, তুমি তা হলে এলে? মাথাটা ফাটালে কী করে?
পিসিমা অবাক হয়ে বললেন, জয়, তুমি? কেমন আছ তোমরা? কতদিন পরে দেখা! তুমি আগের চেয়ে আরও ফরসা হয়েছ। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে তোমাকে!
সবাই বারান্দায়। কেউই সাহস করে ঘরে ঢুকছে না। মুকু পিসিমার ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বললে, নতুন জায়গা। আড়ষ্ট লাগছে তাই না? চলো ভেতরে চলো। ভয় কী?
হরিশঙ্কর ডাকলেন, মুকু!
অতন্দ্র প্রহরীর মতো উত্তর, মেসোমশাই।
তোমার অনেক কাজ। ছেলেমেয়ে তিনটেকে ফলাও করে চানের ব্যবস্থা করে দাও। সাবানের কৃপণতা কোরো না। চুলে উকুন থাকা অসম্ভব নয়। তার ব্যবস্থা কাল হবে। পরিষ্কার জামাকাপড় পরাও। জামাকাপড়, বলে হরিশঙ্কর হোঁচট খেলেন। ছোটদাদুকে বললেন, গ্রেট মিস্টেক। প্রলিফিক ব্লান্ডার।
ছোটদাদু বললেন, কী হল আবার?
আমাদের উচিত ছিল এক সেট করে জামাকাপড় কিনে আনা। এখন এরা কী পরবে!
মুকু বললে, আপনি ভাববেন না মেসোমশাই। আমি ইমপ্রোভাইস করছি।
হরিশঙ্কর বললেন, এই তো চাই! যাও মা। তুমি এদের ইনচার্জ।
রান্নাঘরে কাকিমা রাঁধছিলেন। বেরিয়ে এলেন। এসেই গুনতে শুরু করলেন এক দুই তিন চার। নিজের মনেই বললেন, পার হেড আটখানা, তার মানে আরও ছাপ্পান্ন খানা রুটি। আধখানা কুমড়ো, দু’সের আলু। মাছ হবে না। দুধ আছে, সুজি দিয়ে পায়েস হবে। মুকু!
কাকিমা মুকুকে ডাকলেন। দু’সের আটা বের করে ঠাসতে শুরু করি।
হরিশঙ্কর বললেন, চিন্তার কিছু নেই। আমি সাফা হয়ে এসে তোমাকে সাহায্য করছি।
পিসিমা বললেন, ছোটদা, আমি আছি।
মুকু বললে, আমি কী করতে আছি!
আমাদের বাড়ির পুরনো রীতি অনুসারে মাঝরাতে জেগে উঠল সংসার। জয়নারায়ণ রান্নার এক্সপার্ট। তিনি বসে গেলেন হামানদিস্তা নিয়ে। ভাজা মশলা গুঁড়ো করতে। কুমড়োর ছক্কায় ভাজা মশলা না পড়লে জমে না। তালে তালে হামানদিস্তা চলেছে। জয়নারায়ণ বলছেন, প্রথমটা ঢিমে তিনতাল, তারপর ঝাঁপতাল, তারপর দাদরা। দাদরায় মশলা মিহি।
মুকুর মাথা খাটানোর ফলে গোটাকতক ক্লাউন বেরিয়ে এল ভেতরের ঘর থেকে। পিসতুতো ভাই একটা আন্ডারওয়ার পরেছে। বিশাল তার সাইজ, ফলে মনে হচ্ছে থ্রি কোয়ার্টার পায়জামা। তার ওপর হরিশঙ্করের সুবৃহৎ হাতাঅলা গেঞ্জি। সেটা আর গেঞ্জি নেই, মনে হচ্ছে পাঞ্জাবি। মেয়েদুটো পরেছে মুকুর শাড়ি, পাটে পাটে জড়িয়ে। জ্যান্ত মমির মতো পায়ে পায়ে ঘুরছে। বাড়ি একেবারে জমজমাট। রান্নার হুঁকছোঁক শব্দ। চাকি বেলনে রুটি ঘুরছে গোল হয়ে।