সুখে বাঁচার কায়দাটা কী?
দুঃখটাকে মেনে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি। রিক্ততার মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি। প্রত্যাশা বর্জিত জীবন। আমাকে কেউ কিছু দেবে না, পারলে কেড়ে নেবে, পথ আর বাধা দুটোই থাকবে একসঙ্গে। কেউ আমার প্রশংসা করবে না, নিন্দাই করবে। আমাকে নিয়ে আলোচনা হবে না, হবে সমালোচনা। আমার কোনও বন্ধু থাকবে না, সকলেই শত্রু। সকলেই আমাকে ব্যবহার করবে। যারা কাছে আসবে, আসবে স্বার্থের কারণে। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে আর চিনতে পারবে না। আমার ভাল হলে সবাই দুঃখ পাবে, খারাপ হলে ভয়ংকর আনন্দ হবে। তোমাকে শুধু দিতে হবে, পাবে না কিছুই। পৃথিবীতে ভালবাসা নেই, আছে ঘৃণা। জীবন একটা খেলা, চালে ভুল হলেই হার। তা হলে তোকে একটা কবিতা শোনাই :
The world won’t care if you quit
And the world won’t whine if you fail;
The busy world won’t notice it,
No matter how loudly you wail.
Nobody will worry that you
Have relinquished the fight and gone down
For it’s only the things that you do
That are worth while and get your renown.
The quitters are quickly forgot;
Of them the world spends little time;
And a few e’er care that you’ve not
The courage or patience to climb.
So give up and quit in despair
And take your place back on the shelf
But don’t think the world’s going to care;
You are injuring only yourself.
কী অসাধারণ স্মৃতি হরিশঙ্করের! এই কবিতাটা আমাকে একসময় মুখস্থ করিয়েছিলেন। কোথাও এতটুকু বিস্মরণ হল না। অপূর্ব উচ্চারণ। কখনও কোনও রেফারেন্স দিতে হলে বইয়ের পাতা ওলটাতে হয় না। আমাকে একদিন কথামৃত খুলে দেখিয়েছিলেন স্মৃতির রহস্যটা কী! শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমাচরণকে বলছেন, আর এক আছে ধৈয্যরেতা। আগে রেতঃপাত হয়েছে, কিন্তু তারপর বীর্যধারণ। বারো বছর ধৈর্যরেতা হলে বিশেষ শক্তি জন্মায়। ভিতরে একটি নতুন নাড়ি হয়, তার নাম মেধা নাড়ি। সে নাড়ি হলে সব স্মরণ থাকে– সব জানতে পারে।
হরিশঙ্কর আন্ডারলাইন করে রেখেছেন ঠাকুরের উক্তি, বীর্যপাতে বলক্ষয় হয়। স্বপ্নদোষে যা বেরিয়ে যায়, তাতে দোষ নাই। ও ভাতের গুণে হয়। ওসব বেরিয়ে গিয়েও যা থাকে, তাতেই কাজ হয়। তবু স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। শেষে যা থাকে, তা খুব রিফাইন হয়ে থাকে। লাহাদের ওখানে গুড়ের নাগরি সব রেখেছিল, নাগরির নীচে একটি একটি ফুটো করে, তারপর এক বৎসর পর দেখলে; সব দানা বেঁধে রয়েছে। মিছরির মতো। রস যা বেরিয়ে যাবার, ফুটো দিয়ে তা বেরিয়ে গেছে।
হরিশঙ্করের স্মৃতির রহস্য এই মেধা নাড়ি। ছোটদাদুরও স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। দুই যোগী আমার সামনের আসনে পাশাপাশি। হরিশঙ্কর তার সামনের আসনের জানলার ধারের ভদ্রলোককে বললেন, চলন্ত বাসে অনবরত ওইভাবে থুতু ফেললে পেছনে যারা বসে আছে তাদের গায়ে লাগে।
ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, কোথায় ফেলব? নিজের কোলে?
হরিশঙ্কর বললেন, তখন থেকে অত থুতু ফেলছেন কেন? আপনার মনে হয় কৃমি হয়েছে। ভাল ওষুধ আছে হোমিওপ্যাথিতে, সিনা থার্টি।
ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আমার ডাক্তারি করতে বলিনি। চুপচাপ বসুন।
হরিশঙ্কর মৃদু হাসলেন। জামার বুকপকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে একটা কোণ ছিঁড়ে গোল করে পাকিয়ে নিজের নাকে ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগলেন। এইবার যা হবে আমি জানি। ভয়ে সিঁটিয়ে রইলুম। নির্ঘাত মারামারি। হরিশঙ্কর বরদাস্ত করেন না অসভ্যতা। বিশাল একটা হাঁচি একেবারে ভদ্রলোকের ঘাড় তাক করে। আপ্লুত করার মতো নিখুঁত একটি হাঁচি। বম্ব-ব্লাস্টের মতো।
ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, এ কী অসভ্যতা?
হরিশঙ্করও বললেন, এ কী অসভ্যতা!
ভদ্রলোক বললেন, গায়ে লাগছে না?
হরিশঙ্কর বললেন, গায়ে লাগছে না?
ভদ্রলোক বললেন, আশ্চর্য।
হরিশঙ্কর বললেন, আশ্চর্য!
ভদ্রলোক বললেন, অদ্ভুত।
হরিশঙ্কর বললেন, অদ্ভুত। যেন আয়নায় বিম্ব আর প্রতিবিম্ব। বাস ছুটছে হইহই করে।
২.৪৯ The time, which steals our years away
হরিশঙ্কর আর সেই বাসযাত্রীর দ্বন্দ্ব আরও কতদূর এগোত কে জানে? হয়তো হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত। ভদ্রলোক একবার মাত্র ছোটদাদুর চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে গেলেন। কী ছিল সেই চোখে? আমি তো বসে আছি পেছনে, প্রস্তুত হয়ে। তেমন কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ব।
ছোটদাদু বললেন, ছি ছি! যাচ্ছেন জামাইবাড়ি! নাতিকে কী শিক্ষা দেবেন? পিচিক পিচিক থুতু ফেলা! ভদ্রলোক কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ছোটদাদু বললেন, শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে এত অশান্তিতে রয়েছে, বনিবনা হচ্ছে না, মেয়ে কি আপনার স্বভাবই পেয়েছে? এইরকম উদ্ধত, অসভ্য! মেয়ের মা তো মাটির মানুষ ছিলেন! সেইজন্যই বুঝি তাকে ধামসে শেষ করে দিলেন! আপনি তো মশাই মহাবদ! কাছারির চাকরিটা খোয়ালেন কী করে? এদিকে তো পাইলসের যন্ত্রণায় ছটফট করেন।
উলঙ্গ মানুষ যেভাবে নিজেকে ঢাকবার চেষ্টা করে, ভদ্রলোক সেইভাবে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন। মুখে অদ্ভুত একটা ভয়ের ভাব। পারলে কান ধরে জিভ বের করেন, এইরকম একটা অবস্থা। ছোটদাদুর এই কাণ্ডটা আমি খুব উপভোগ করি। ভীষণ একটা শ্রেষ্ঠত্বের ভাব আসে আমার মনে। এমন একজন মানুষ আমার দাদু, যিনি সমস্ত তামসিকতা এক ফুৎকারে স্তব্ধ করে দিতে পারেন। পাজা তুলোর মতো উড়িয়ে দিতে পারেন মানুষের যত নীচ অহংকার। লোকটি কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেলেন। আর বাসের কনডাক্টর, এতক্ষণ যিনি পুরো পর্যায়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি এগিয়ে এসে বললেন, মহাপুরুষের চরণে প্রণাম।