সকলেই সমস্বরে বললেন, না। কারও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
আমরা বাসে উঠে বসলুম। কারও মুখে কোনও কথা নেই। আমরা বেঁচে ফিরছি, না মরার জন্যে দল বেঁধে চলেছি, মনের অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই। বিষণ্ণ, বিভ্রান্ত। হরিশঙ্কর পকেট থেকে ছোট্ট একটা নোটবুক বের করে মগ্ন হয়ে আছেন। আমি ঠিক তার পেছনে বসে যতটুকু দেখতে পাচ্ছি, তাইতে মনে হচ্ছে লেখা আছে উদ্ধৃতি। ছোটদাদু বসেছেন হরিশঙ্করের পাশে।
ছোটদাদু জিজ্ঞেস করছেন, কীসে ডুবে গেলি?
হরিশঙ্কর বললেন, নোটস। এতে কিছু কিছু পয়েন্টস লেখা আছে। মেডিক্যাল গাইডসের মতো, লিভিং গাইডস। প্র্যাকটিক্যাল নোটস ফর এফেক্টিভ লিভিং। কীভাবে তুমি বাঁচবে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার গণিত। মানুষ গাছে সার দেয়, পেটে দানাপানি দেয়, অভিভাবকহীন নিঃসঙ্গ মনকে মানুষ কী দেয়! অনাথ বালকের মতো বসে আছে ফুটপাথে। ঢোলসহরত করে মিছিল যাচ্ছে। আলোর রোশনাই দিয়ে, দেখছে। সেজেগুজে বড়মানুষের মেয়ে যাচ্ছে, দেখছে। ঝকঝকে মোটরগাড়ি যাচ্ছে, দেখছে। দুটো লোক ঝগড়া করতে করতে যাচ্ছে, দেখছে। কেউ ভুট্টা খেতে খেতে চলেছে, দেখছে। রাত হল, দেখছে। পথ নির্জন থেকে নির্জনতর হয়ে গেল। নিবে গেল দীপাবলী। বন্ধ হয়ে গেল বাহারি সব দোকান। রাতের বাতাস বহে গেল রাজপথের ছেঁড়া কাগজ উড়িয়ে। অনাথ বালক বসে আছে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। কেউ এসে হাত ধরে বলবে না, চলো, ওঠো, রাত হল। কেউ তাকে গরম জলে চান করাবে না, ভাল পোশাক পরিয়ে সেন্ট ছিটিয়ে দেবে না, গরম খাবার খাইয়ে নরম বিছানায় শুইয়ে দেবে না। মধ্যরাতের নির্জন পথে একা বালক। নিরাশ্রয় একটি পাখি। সেই মনের ধাত ধরতে পারে আমার এই ছোট্ট খাতা। আমি এটাকে আরও বড় করব। নাম হবে, মাই এনকাউন্টার উইথ লাইফ। জীবন পথিক।
বাস চলেছে প্রচণ্ড গতিতে। আমার পাশে জানলার ধারে আমার পিসতুতো ভাই। বাসে এখনও তেমন ভিড় হয়নি। চিৎকার চেঁচামেচি তেমন শুরু হয়নি। মানুষের কপচাকপচি। ভাইয়ের চোখ বুজে আসছে। মুখ দেখে মনের ভাব পড়া যাচ্ছে না। বাস কলকাতার দিকে যাচ্ছে, না যাচ্ছে। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে! আকাশে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ মারার মতো, একমাত্র বাতাসই ভরসা।
ছোটদাদু বলছেন, তার একটা টুকরো শোনা না!
শুনবি? তা হলে শোন, সুইচ অফ সুইচ অন। কখনও তুমি থাকবে কখনও তুমি থাকবে না। মন বসাবে, মন তুলবে। উপমা পাখি। ডালে বসল, ফল ঠোকরাল, শিস দিল, পোকামাকড়ের দিকে নজর গেল, হঠাৎ উড়ে চলে গেল একসময়। মনের দেহ-যুক্তি, দেহ-বিযুক্তি। ঘটনার মধ্যে দেহ আছে, কিন্তু মন নেই। পাখি উড়তে পারে, মন কেমন করে উড়বে। ঘুড়ি ওড়ে, ঘুড়ির লেজ ওড়ে কেমন করে? ঘুড়ির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। মন উড়বে ভাব আর ভাবনার লেজ ধরে। মনকে তল্লাশ দিতে হবে, যাও মন পাহাড়চুড়োয়, যাও মন সমুদ্রের ঊর্মিমালায়, যাও মন আমাজনের রনফরেস্টে। ক্ষুদ্র থেকে বিশালের দিকে ঠেলে দাও। এইটা রপ্ত করার জন্যে ছোটখাটো ব্যায়াম অভ্যাস করা যেতে পারে। যেমন বাস চলার এই শব্দে তুই কি আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিস?
ছোটদাদু বললেন, না।
আচ্ছা, এইবার চেষ্টা কর।
ছোটদাদু কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন, এইবার পাচ্ছি।
কোন কায়দায় পেলে?
কিছুই না মনটাকে গুটিয়ে নিয়ে এলুম। সবকিছু থেকে সরিয়ে উৎকর্ণ হতেই শুনতে পেলুম।
ছোটদের ম্যাগাজিনে এক ধরনের ধাঁধা ছাপা হয় দেখেছিস? একটা ম্যাপের মতো, রোড ম্যাপ। একগাদা পথ। একটার ঘাড়ের ওপর দিয়ে আর একটা চলে গেছে, দুটোকে জড়িয়ে তৃতীয় আর একটা। সব পথই কিছু দূর পর্যন্ত গিয়ে আর নেই। আটকে গেছে। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার একটা পথই খোলা আছে। সেটাকে খুঁজে নিতে হলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চাই, কনসেনট্রেশন চাই। পৃথিবীর জটিল আবর্ত থেকে পথ চিনে লক্ষ্যে পৌঁছোবারও সেই একই কায়দা। দৃষ্টি স্থির, মন স্থির। প্লেন থেকে নীচে তাকালে কী দেখবে? ছবির মতো পড়ে আছে জনপদ। নদী, খাল, ব্রিজ, পথ, বাড়ি, মনুমেন্ট, গির্জা, মন্দির। কোথাও কোনও জটিলতা নেই। কোনটা কোথায়, কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, একেবারে পরিষ্কার ছবি। জীবন থেকে সরে গিয়ে জীবনের নকশা দেখে নিতে হয় মাঝে মাঝে। মনকে সরাও, মনকে ঢোকাও। ঘাড়-মুখ গুঁজড়ে সংসারে পড়ে থেকো না। সবেতেই আছি আবার কিছুতেই নেই। ইউ লিড এ লাইফ অ্যান্ড লার্ন দি আর্ট অফ লিভিং।
ছোটদাদু বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বেশ বলেছিস তো! তোর নোটবুকে আর কী আছে?
বাস থামছে, বাস চলছে। আমার পিসতুতো ভাইয়ের মাথাটা আমার ডান কাঁধে নেমে এসেছে। গভীর ঘুমে কাদা। অন্য কোনও সহযাত্রী হলে জাগিয়ে দিয়ে বলতুম, সোজা হয়ে বসুন। এখন একটা কেমন করুণার ভাব আসছে। কী অসহায়! দুটো বোন। তাদের লেখাপড়া, বিয়ে। এই ছেলেটিকেই হতে হবে পিলার, হতে হবে ছাতা। কত রাজপথ জনপথ পেরিয়ে মরুভূমি সাগরের সীমানায় এই ছেলেটিকে যেতে হবে। তেল চিটচিটে চুল। জামার কাঁধে ছোপ পড়ে যাবে। আমার শহুরে মনের সংকীর্ণতায় নিজেকেই নিজে ধমক দিলুম। কাধটাকে আরও এগিয়ে দিলুম মাথাটা যাতে পড়ে না যায়।
হরিশঙ্কর বলছেন, মানুষ যখন বাঁচতে শেখে তখন তার জীবন শেষ হয়ে আসে। আমাদের স্কুল কলেজের আধুনিক শিক্ষা বড় একপেশে। রোজগার করতে শেখায়, সুখে বাঁচার কায়দাটা শেখায় না।