ছোটদাদু সংশোধন করলেন, ছেড়ে যায় না, ছিঁড়ে যায়।
ছেঁড়ার আগে ছেড়ে যায়।
তোর কোনও দুঃখ হচ্ছে না?
কীসের দুঃখ? কার জন্যে দুঃখ? এ গ্রুপ অফ ক্রিমিন্যালস। তোদের এই ধর্মটাকে দেশ থেকে বিদায় কর।
ধর্মকে তো বিদায় করা যাবে না ভাই। ওটা মানুষের সঙ্গেই জন্মেছে। পাখি থাকলে ডিম থাকবে, ডিম থাকলে পাখি। তুই যা দেখছিস, এ হল ধর্মের ব্যভিচার। এর মধ্যে সেক্স আছে, গ্রিড আছে। ধর্ম এখানে ভেক। ধর্মের আড়ালে অনাচারের খেলা।
তোরা এইটাকে কন্ট্রোল করতে পারছিস না কেন?
কারণ ধর্মের জগতে কোনও পুলিশ নেই। তোমরা ধর্মাবতার বলে যাদের আদালতে বসিয়ে রেখেছ, তাদের এক্তিয়ারে এই অধর্মটা পড়ে না। ধর্মের আদালতের ধর্মাবতার হল মন। সত্যপথে মন করো আরোহণ প্রেমের আলো জ্বালি চলো অনুক্ষণ/ সঙ্গেতে সম্বল রেখো পুণ্যধন, গোপনে অতি যতনে ॥ লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ পথিকের করে সর্বস্ব লুণ্ঠন/ পরম যতনে রাখো রে প্রহরী শম দম দুই। জনে ॥
ছোটদাদু সম্পূর্ণ ভাবস্থ হয়ে বিখ্যাত গানের লাইন বলছেন। সামান্য সুরও আছে। এমন অদ্ভুত রচনা অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর, হরিশঙ্করও তন্ময় হয়ে গেছেন। স্বামীজির বড় প্রিয় গান। ঠাকুরকে প্রায়ই। শোনাতেন। ছোটদাদু পরের অনবদ্য লাইনক’টি বলছেন, সাধুসঙ্গ নামে আছে পান্থধাম, শ্রান্তি হলে তথায় করিও বিশ্রাম। পথভ্রান্ত হলে শুধাইও পথ, সে পান্থ-নিবাসী জনে । যদি দেখো পথে ভয়ের আকার প্রাণপণে দিয়ে দোহাই রাজার/ সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে ॥
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, হরিশঙ্করের দু’চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জলের ধারা নেমেছে। এই মূর্তি আমার চেনা, ক্ষতবিক্ষত এক যোদ্ধার। জতুগৃহ দগ্ধ হয়ে যাওয়ার পর যদি জীবিত কেউ দগ্ধাবশেষ থেকে উঠে আসতে পারতেন, তার চেহারা এইরকম হত। মনের চেহারা। হরিশঙ্কর তার নিখুঁত উচ্চারণে ‘সাবিত্রী’র কয়েকটি লাইন বললেন,
Ardent from the sack of happy peaceful homes/ And gorged with slaughter, plunder, rape and fire/ They made of human selves their helpless prey/ A drove of captives led to lifelong woe.
অফিসার এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, কেস খুব ঘোরালো। দুটো কু পাওয়া গেছে। ইদারার লাশের মুঠোয় কিছু চুল পাওয়া গেছে। ভৈরবীর মুঠোয় একটা তাবিজ। লাশের মুঠোয় মেয়েদের চুল থাকলে ব্যাপারটার একটা সহজ সমাধান হয়ে যেত। মুঠোয় পুরুষের চুল। তার মানে তৃতীয় আর একজন একসঙ্গে এই ডবল মার্ডারের জন্যে দায়ী। সে কে? গভীর জলের ব্যাপার।
হরিশঙ্কর খুব সহজ গলায় বললেন, আমাদের মধ্যে কারওকে অ্যারেস্ট করতে চান?
অফিসার অবাক হয়ে বললেন, আপনাদের অ্যারেস্ট করব কেন? আপনারা তো এই একটু আগে স্পটে এলেন। এসব কাল মাঝরাতের ঘটনা। আমাদের প্রথম সন্দেহভাজন লোক হল ভৈরবীর স্বামী।
হরিশঙ্কর বললেন, আমার বোন আশাকে সন্দেহ হয় না?
ছোটদাদু অবাক হয়ে হরিশঙ্করের মুখের দিকে তাকালেন। কত সহজে একজন মহিলাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। হরিশঙ্কর যেন আসামি পক্ষের উকিল!
অফিসার বললেন, না, হচ্ছে না। দুর্বল মহিলার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়।
সারারাত ওই দাওয়ায় শুয়ে থেকে এত বড় একটা ঘটনা টের পেল না!
তার সহজ ব্যাখ্যা, মহিলা রাতে ত্রিসীমানায় ছিলেন না।
কোথায় ছিল তা হলে?
ছোটদাদু বললেন, তুই কি আশাকে অপরাধী প্রমাণ করতে চাস?
হরিশঙ্কর সকলকে অবাক করে বললেন, মিথ্যে কথা বলবে কেন?
অফিসার বললেন, আশ্চর্য মানুষ আপনি! সত্যের জন্যে এত বড় একটা বিপদ ডেকে আনতে চাইছেন! আপনি ঠিকই বলছেন, উনি সত্য গোপন করছেন।
তারিণীবাবু বললেন, সত্যটা আমি বলছি, আশা আমার কাছে ছিল। আমি অবিবাহিত পুরুষ। জায়গাটা শহর নয় গ্রাম, হাজার কথা হবে, সেই কারণেই মিথ্যা বলেছে। আমি একটু দেখাশোনা করি বলে ইতিমধ্যেই অনেক কথা হয়েছে। সেসব আমি গ্রাহ্য করিনি। তবু একটু সাবধান হতেই হয়। আমি শিক্ষক।
হরিশঙ্কর বললেন, তার মানে কোথাও একটু পাপবোধ আছে!
ছোটদাদু সামান্য ধমকের সুরে বললেন, কী হচ্ছে হরিশঙ্কর?
হরিশঙ্কর অম্লান বদনে বললেন, সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল। লুকোচুরিটাই পাপ। আশা আমাদের সত্য কথাটা বললেই পারত। আমরা তো গ্রামের লোক নই। আই হেট লায়ারস দ্যান মার্ডারারস, দ্যান প্রস্টিটিউটস।
যেন বাজ পড়ল! আমরা সবাই স্তম্ভিত। তারিণীবাবুর মুখটা ভীষণ করুণ দেখাল।
অফিসার বললেন, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আপনারা সোজা কলকাতায় চলে যান। দায়িত্ব আমার। এখন ট্রেন নেই। বাসে করে বর্ধমানে চলে যান। সেখান থেকে লোকাল ধরে কলকাতা। এইসব ভুলে যান। আমি আর সময় দিতে পারছি না। আমার এলাকায় খুন এই প্রথম।
সদলে আবার আমরা রাস্তায়। যথারীতি হরিশঙ্কর আবার একটা সমস্যা তৈরি করে ফেললেন, এদের জিনিসপত্তরের কী হবে? সবই তো পড়ে রইল!
ছোটদাদু বললেন, ও সবই এখন পুলিশের হেফাজতে। সুখে থাকতে ভূতের কিল খেয়ে লাভ কী?
আশার ছেলেমেয়ের স্কুল ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের কী হবে?
সব, সব হবে। পরে হবে। ঠিক সময়ে হবে।
আবার আমাদের চলা শুরু হল। এইবার আর স্টেশনের দিকে নয়, বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আর যেন পারা যাচ্ছে না। শরীর ভেঙে আসছে। বিমলাদি বলেছিলেন, থেকে যাও তুমি। বিদ্রোহী সন্তান হয়ে যদি রয়ে যেতুম, তা হলে অন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা হত। হয়তো ভেড়া হয়ে যেতুম। ভয়ও ছিল। ইদারায় না পড়ে হয়তো গলায় দড়ি দিতে হত। এখন বুঝতে পারছি, মেলায় বিমলাদি আমাকে কী করেছিলেন। যা কোনওদিন কেউ করবে না। বাসস্ট্যান্ডে এসে হরিশঙ্কর বললেন, খাওয়াদাওয়ার প্রয়োজন আছে?