হরিশঙ্কর বললেন, ওয়ান্ডারফুল! পারফেক্ট ম্যাথমেটিক্স। আমি ভাবলুম অলৌকিক কোনও দূত এসে আপনাকে খবর দিয়েছে।
অফিসার বললেন, আপনি? আপনার পরিচয়?
ছোটদাদু বললেন, আমার ভাগনে।
অফিসার হুংকার ছাড়লেন, উদাস!
উদাস যে কারও নাম হতে পারে, ভাবা যায় না। কুচকুচে কালো একটি ছেলে ঘরে এল। চায়ের হুকুম হল। পুলিশ ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে গেছেন। ডেডবডি তুলতে সময় লাগবে কিছুক্ষণ। তারপর যাবে পোস্টমর্টমে।
ছোটদাদু বললেন, আমার ভাগনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেমেয়ে নিয়ে।
অফিসার বললেন, এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার কোয়ার্টারে।
হরিশঙ্কর বললেন, সেটা যে বড় অস্বস্তিকর হবে আপনার পরিবার-পরিজনের পক্ষে। আচ্ছা কোনওরকমে তালা ভেঙে ওদের গৃহপ্রবেশ করানো যায় না?
অফিসার চেয়ার ছেড়ে উঠেছিলেন, আবার বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ ভাবলেন। ভেবে বললেন, তালাটা ভাঙলে কী এমন বেআইনি হবে! প্রপার্টিটা কার?
হরিশঙ্কর বললেন, রাধা ভাইকে লিখে দিয়েছিল এটুকু জানি। তারপর কার হাতে গেছে জানি না। তবে এর মধ্যে কে এক ভৈরবী আছে।
ও সব ভৈরবী-টেরবি আমরা গ্রাহ্য করি না। আমরা আইন দেখব। তালা ভাঙার অধিকার পুলিশের আছে। অনুসন্ধান সার্চ আমাকে করতেই হবে। এটা যদি মার্ডার কেস হয়?
হরিশঙ্কর বললেন, মার্ডার হতে পারে?
সবই হতে পারে। পুলিশ লাইনে থেকে বুঝেছি, পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। টাকার জন্যে মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। সব পারে।
প্রায় মগের মতো আকার এক একটা কাপের। স্ট্রেচারের মতোই বড় ট্রে-তে চেপে চলে এল চা। চায়ে চান করা যায়। এদিকে খালি পেটে চো চা শব্দ হচ্ছে।
অফিসার বললেন, তাড়াতাড়ি শেষ করে নিন। চায়ের সঙ্গে আর কিছুই দেওয়া গেল না।
আমরা কোঁত কোঁত করে চা শেষ করলুম। জিপ আমাদের নিয়ে চলল ঘটনাস্থলের দিকে। বেশ ভিড় জমে গেছে। দেহ সবে তোলা হয়েছে ইঁদারা থেকে। মাঝারি গড়নের একজন মানুষ। কঁকড়া চুল। গলায় জড়ানো লাল একটা কাপড়ের টুকরো। ঠোঁট ফাঁক। গাজলা বেরিয়েছে। হাতের মুঠোয় শক্ত করে কী একটা ধরা। দেহটা উঠোনে চিত হয়ে পড়ে আছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক তারিণীবাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, একটা মহৎ পরিবার এইভাবে শেষ হয়ে গেল। নেশাভাং মানুষকে কোন দুর্গতির দিকে নিয়ে যায়! কী ছেলে ছিল! শেষ পরিণতিটা কী হল!
তাঁর আক্ষেপ শোনার মতো কেউ নেই। ভয়ংকর কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। পুলিশের নানা ফ্যাচাং। কোথায় কী পড়ে আছে, তার অনুসন্ধান। খাঁড়া, খড়ম। বিড়ির টুকরো। পায়ের ছাপ। সেই ছাপে আমাদের পা আছে। দাওয়া থেকে ইঁদারার দূরত্ব। শুরু হল জেরা। কী ক্লান্তিকর ঘটনা। এরই নাম তল্লাশ। খাতায় লেখা হচ্ছে মৃতের বর্ণনা। মিডিয়াম বিল্ড। ফেয়ার কমপ্লেকশনড। লং কারলি হেয়ার। হাইট। বার্থমার্ক। পার্টেড লিপস, ফোমিং। বালজিং আইজ। ঘাস্টলি স্টেয়ার। ক্লেঞ্চড ফিস্ট। ব্রুইজ, কাটস, ল্যাসিরেশন। সোলেন টেস্টিকলস। ডিস্টেন্ডেড স্টম্যাক। ফেন্ট রেড স্পট অন দি ফোরহেড, নট ব্লাড। রাইগার মরটিস হ্যাঁজ স্টার্টেড। বর্ণনার শেষ নেই।
রামশঙ্কর, কুম্ভকার। তিনি কাল মৃতকে কখন দেখেছেন? কী অবস্থায় দেখেছেন? প্রসাদ রায়, পুরোহিত। কাল শেষ কথা কখন বলেছেন, কী বলেছেন? আমরা প্রথম এসে কী দেখেছি? ইঁদারায় প্রথম কে দেখে? কী অবস্থায় দেখেছে? আমরা কী দেখলুম? আমরা কেন এলুম? কী জন্যে এলুম? কাল রাতে কোথায় ছিলুম? প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
অবশেষে চাদর- চাপা দেহ চলে গেল পুলিশের হেফাজতে। অফিসার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, এইবার তালাটা ভাঙা যাক। তারিণীবাবু, আপনি সাক্ষী থাকুন।
একটা চাড় মারতেই তালা খুলে গেল। দরজাটা খোলার সময় কবজায় কিচ করে একটা শব্দ হল। ঢুকতে গিয়ে সবাই থমকে গেলেন। তারিণীবাবু, অফিসার, সহকারী সবাই। ঘরটা বেশ বড়ই। চাপা আলো থমথম করছে। সামনেই লাল মেঝেতে স্বাস্থ্যবান এক মহিলার মৃতদেহ চিত হয়ে পড়ে। আছে। পরনে লাল টকটকে কাপড়। গলার ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে বুকের কাছটা দগদগে লাল। এলোচুল ছড়িয়ে আছে চারপাশে। কপালে বিশাল লাল টিপ। ফরসা টকটকে রং। কশ বেয়ে পিলপিল করে নেমে আসছে কালো পিঁপড়ের দল। পা দুটো দুপাশে ছড়ানো। এক হাতের মুঠোয় একটা তাবিজ। অফিসার বললেন, ঘাস্টলি মার্ডার। গ্যাপিং উন্ড।
২.৪৮ Every man is the architect
কোনও কোনও সময় বেঁচে থাকলেও মানুষের মরে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হয়। বোধ, বুদ্ধি, সব লোপাট হয়ে যায়। নিজেকে মনে হয় চলমান যন্ত্রের মতো। এক ঝলকের দেখা কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না সেই দৃশ্য। কেবলই ভাবছি, এমন একটা দেহ এমন একটা সৌন্দর্য মানুষ ধ্বংস করে কীভাবে! কী ভেবে? পাথরে-কোদা শরীর, যেন খাজুরাহোর মন্দিরগাত্র থেকে একটা মূর্তি খুলে পড়ে গেছে। চরিত্র যাই হোক, প্রকৃত সাধিকা কি না সে বিচারেও যাচ্ছি না, সুন্দরী এক মানবী, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোথায় যেন বিমলাদির সঙ্গে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আমার চোখ পাপীর চোখ, ভোগীর চোখ। নিজেকে তিরস্কার করতে ইচ্ছে করছে।
হরিশঙ্কর পাশেই ছিলেন। ছোটদাদুকে বললেন, জীবনের আর একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। আইন বেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াবে। জেল, প্রাণদণ্ড সবই হয়ে যেতে পারে। মন্দ হবে না। আমার ধারণা, ফঁসি বেশ আরামদায়ক। গলার কাছে বেশ একটা টান পড়ে তো! শিরাটিরা বেশ ছেড়ে যায়।