হঠাৎ হরিশঙ্কর আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, কেন এমন বিরস বদন হেরি সখী। বড় বিপদে পড়েছ তাই না? কোথায় তোমার সুখশয্যা! সুদৃশ্য স্নানঘর, সুগন্ধী সাবান! Soak your life in a gallon of danger, spice it with powder of time and slowly roast it in the fire of your courage and enjoy a good dinner. বুঝলে কিছু? এক গ্যালন বিপদে জীবনটাকে চোবাও, চূর্ণ সময়ের মশলা মেলাও, সাহসের আঁচে ধীরে ধীরে রোস্ট করো, বসে যাও জীবনের মহাভোজে। আজ তাই হবে। তোমাদের সন্দেশ মারা ফুরফুরে আধ্যাত্মিকতার কোনও স্থান নেই রক্তমাংসের পৃথিবীতে। ওটা এক ধরনের রোমান্টিকতা। বড়বাবুদের বিলাসিতা। লাঙল, কোদাল, কুড়ল, খোস্তা, ছোরাছুরি, কাড়াকাড়ি, ছেঁড়াছিড়ি, এই হল জীবন। কোথায় গেল তোমাদের হিউমার? মুখ দেখে মনে হচ্ছে বধ্যভূমির দিকে চলেছ! এসো গান ধরো, জগৎজননী জাগিয়াছে আজি, জয় মা তারিণী গাও রে,বাজাও ডঙ্কা, নাহিকো শঙ্কা, ঘুচে গেছে ভবভয় রে ॥
হরিশঙ্কর নিজেই গাইছেন। এই অবস্থায় গলায় সুর আসছে! কোন উৎস থেকে এই ভয়ংকর শক্তি আসে! আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। ছোটদাদু কি পরাজিত হলেন হরিশঙ্করের জীবনবেদের কাছে? তন্ত্র-মন্ত্র সব বোগাস? আমরা দেখতে দেখতে থানার চৌহদ্দির মধ্যে এসে ঢুকলুম। বিশাল একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ঝিলমিল করে আলোর বিলিব্যবস্থা করছে। ঢনঢনে একটা জিপ গাড়ি জরদগব প্রশাসকের মতো একপাশে পড়ে আছে। একজন হাবিলদার বগলে লাঠি চেপে হাতের তালুতে খইনি ডলছে। আমাদের দেখে ফটাস ফটাস করে তিনবার চাপড় মারলে, সাদা চুনের গুঁড়ো উড়ে গেল খানিক।
কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় পিসিমারা থমকে দাঁড়ালেন। আমরা তিনজন এগিয়ে গেলুম। হরিশঙ্কর হঠাৎ আমাকে বললেন, মনে করো আমি নেই, তুমি কেসটা হ্যান্ডল করো তো!
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। এ যে দেখি বিপদের ওপর বিপদ। ডবল বিপদ। তবু মনে হল হেরে যাব? মনে পড়ে গেল হরিশঙ্করের পুরনো শিক্ষা! লেখাপড়ায় লাগাতে বলেছিলেন– সবসময় ভাববে তুমি একজন অথরিটি। তুমি কারও চেয়ে কম যাও না। কেউ তোমার চেয়ে শক্তিশালী নয়। হারার আগে হেরে যাবে না। লড়াই করে হারো, হারবে। আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না ॥/ তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে। তুফান মেলে–
এগিয়ে গেলুম সেই কনস্টেবলের দিকে। বেশ বড় একটা গোঁফের মালিক, কিন্তু গলাটা ভীষণ সরু। যতটা কঠোর হবেন ভেবেছিলুম ততটা কঠোর নন। মোটা লাঠিটা শুধুমাত্র প্রভুত্বের প্রতীক। গরম বাতাস, কৃষ্ণচূড়ার ঝিলিমিলি ছায়া। অসম্ভব সরু গলায় প্রশ্ন এল, কী চাই?
অফিসার ইনচার্জের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কী কেস!
একটু থতমত খেয়ে গেলুম। কেসটা কী? কী বলব? হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমরা কলকাতা থেকে আসছি।
কনস্টেবল অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাদের তো আসার কথা ছিল। এত দেরি হল!
অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে হরিশঙ্করের দিকে তাকালাম। ছোটদাদু হাসছেন মৃদু মৃদু। কী উত্তর দোব? হয়তো অন্য কারও আসার কথা।
কনস্টেবল বললেন, যান যান, তাড়াতাড়ি যান। অফিসঘরে অপেক্ষা করছেন।
একটু আগে কেসটা যাই থাক, এখন আরও জটিল হয়ে গেল। কে আসবে, কারা আসবে! সম্মানিত ওপরঅলা কেউ? এসে পড়েছি আমরা। প্রথমে খাতির। তারপর যেই জানবেন, আমরা তারা নই, তখনই ভয়ংকর অবহেলা। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। বলতেও পারছি না। অহংকারের বাধা!
হঠাৎ ছোটদাদু এগিয়ে গেলেন। এক মাথা কঁচাপাকা কোকড়া কোকড়া চুল। ধবধবে সাদা টুইলের শার্ট রোদে ঝলসাচ্ছে। অপরাজেয় ছোটদাদু। পেছনে আমরা। হরিশঙ্কর অবিচলিত। দেখে মনে হচ্ছে, কোনও ঘটনার মধ্যেই তিনি আর নেই। থেকেও না-থাকাটা হরিশঙ্করের সাধনা। এ আমি আগেও দেখেছি অজস্রবার।
রক পেরিয়ে অফিস। থানার অফিস যেমন হয়। কেঁদো টেবিল। গোদা চেয়ার। অসম্ভব সুন্দর ইউনিফর্ম পরা একজন মানুষ বসে আছেন। সামনে খোলা খাতা। একপাশে ব্যাটন, আর একপাশে টুপি। আমরা ঢোকামাত্রই বললেন, আসুন, আসুন। আপনারা এই বাঁকুড়ার অজ-শহরে?
ছোটদাদু চেয়ার টেনে আর এক অফিসারের মতো বসতে বসতে বললেন, আপনি যাদের কথা ভাবছেন আমরা কিন্তু তারা নই।
অফিসার বললেন, আপনারাই। আপনি তারাপীঠের মহাসাধক। আপনার লেখা বই আমার বাবা পড়েন। আমার ছোটভাই জেসপের ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতায় থাকে। তাকে আপনি গত বছর দীক্ষা দিয়েছেন।
ছোটদাদু বললেন, আমরা আসব জানলেন কী করে?
ওইখানে একটু পুলিশি বুদ্ধি আছে। আপনারা সকালে যে-দোকানে জিলিপি আর চা খেয়েছেন, সেই দোকানে রোজ আমাকেও একবার যেতে হয়। সেরা খাবার। সেখানে গিয়ে শুনলুম, আপনারা গ্রামে ঢুকেছেন। তা থানায় কেন আসবেন! হঠাৎ স্কুলের হেডমাস্টারমশাই তারিণীবাবু খবর আনলেন রাধাবাবুর ইঁদারায় মৃতদেহ। আরও বললেন, তিন ভদ্রলোকের সঙ্গে রাধাবাবুর পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে স্টেশনের দিকে গেলেন। আবার এও বললেন, রাধাবাবুর ভাই গতরাতে রাধাবাবুর বিধবা পত্নীকে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। ঘর থেকে টেনে বাইরে ফেলে দিয়ে দোরতাড়ায় তালা মেরে হাওয়া হয়ে গেছে। এইবার আমার ডিডাকশন, ঝামেলার ভয়ে প্রথমে আপনারা পালাতে চাইবেন, তারপর আপনাদের বিবেক আর বুদ্ধি কাজ করবে। আপনারা ফিরে আসবেন। কোথায় আসবেন? থানায় আসবেন। এমন সময় আমাদের হেড কনস্টেবল এসে জানাল, আপনারা আসছেন। সে আপনাদের ওভারটেক করে জিপে করে আসছিল।