ছোটদাদু বললেন, এদের ঘুম তা হলে কুম্ভকর্ণের ঘুম।
বলেই ছোটদাদু লাফিয়ে উঠলেন। আমি ভাবলুম পিঁপড়ে কামড়েছে। না, তা নয়।
ছোটদাদু বললেন, ইদারায় তা হলে একজন নয়, দু’জন পড়েছে!
হরিশঙ্কর বললেন, ফ্যান্টাসটিক ইম্যাজিনেশন। একা রামে রক্ষা নেই, দোসর লক্ষ্মণ। আর একজন কে? এ ধারণাটা তোর এল কোথা থেকে?
আমি একটা লাল কাপড় দেখতে পেয়েছি। সেটা একটা শাড়ির অংশ।
তার মানে?
মানে ভৈরব আর ভৈরবী দু’জনে জড়াজড়ি করে পড়েছে।
অসম্ভব। দু’জনের জায়গা হতেই পারে না।
অবশ্যই পারে। একজনের ওপর আর একজন। ঘটনাটা আমি দেখতে পাচ্ছি। ওই ভৈরবী ঠেলে ফেলে দিচ্ছিল। ভৈরব তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছিল। একজনের ভারে আর একজনও তলিয়ে গেল।
হরিশঙ্কর হাসলেন, তোর কাব্যপ্রতিভা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু গোয়েন্দা গল্প লেখার ক্ষমতা একেবারেই নেই। দু’জন পড়ল, যে-কোনও একজন তার ঘাড়ে পা রেখে উঠে দাঁড়াত। সে বেঁচে থাকত। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করত। বেশ! হাতে পাঁজি মঙ্গলবার করে তো লাভ নেই, চলো তা হলে, ফিরে গিয়ে থানায় ইনফর্ম করি। দেখা যাক ক’জন ওঠে, একজন না দু’জন। কেস কোথায়। গড়ায় চলো দেখি।
একটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অত বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া যায় না। যদি ভৈরবী ইঁদারায় থাকে, আশার ওপর পুলিশের সন্দেহ পড়বে না। আর ভৈরবী যদি বেঁচে থাকে, আশাকে নিয়ে টানাটানি হবেই।
কেন হবে?
খুব সহজ। পুরো সম্পত্তিটা ভৈরবী দানপত্র করে নিয়েছে।
যদি সম্পত্তিটা নিজের নামে করিয়েই নিয়ে থাকে তা হলে খুনের কী প্রয়োজন?
দখল নেবার জন্যে।
শোন, তুই আধ্যাত্মিক লাইনের লোক, জাগতিক ব্যাপারে মাথা ঘামাসনি। শোন, আশাকে নিয়ে তোরা কলকাতায় চলে যা, আমি ব্যাপারটার শেষ দেখে যাই।
তোকে আর শেষ দেখতে হবে না। অনেক কিছু আছে যার শেষটা না দেখাই ভাল।
আমার এই পালিয়ে যাওয়াটা ভাল লাগছে না। ভীরু কাপুরুষ মনে হচ্ছে নিজেকে।
কিছুকাল আগে তুই ছেলেকে ছেড়ে পালিয়েছিলিস।
ওটা পালানো নয়, ওটা ছিল শিক্ষা দেওয়া। স্বাবলম্বী করার শিক্ষা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা।
ঠিক আছে, এখন চল। আমাদের যাত্রা শুরু করা যাক।
শোন, তোর ভুল ধারণাটা ভেঙে দিই। ইদারায় একজনই আছে। দু’জন নয়। দেহটা ভাসছে। তলায় আর একটা দেহ থাকলে ওইভাবে ভাসতে পারত না। জলের উর্ধচাপ অতটা কাজ করতে পারত না। দিস ইজ সায়েন্স। আনন্দের কারণ নেই। ভৈরবী বেঁচেই আছে।
পিসিমা বললেন, ছোড়দা, আমরা চলে গেলে কোনও অন্যায় হবে না। তুমি আর ওই গ্রামের নোংরামির সঙ্গে জড়িয়ে পোড় না। সবাই গেজেল আর মাতাল। আমাদেরই জমি চারপাশ থেকে দখল করে বসে আছে। ওখানে বেড়া চলে চলে বেড়ায়। আজ দেখলে ওখানে, সকালে উঠে দেখলে। তিন হাত সরে এসেছে তোমার জমির ভেতরে। ক্ষমতা থাকে লড়াই করো। মাথা ফাটাফাটি, রক্তগঙ্গা। ওই ইদারাটা ওকে টানত। কেন জানো তো! সাত বছর আগে বুড়ো বাপকে পাঁজাকোলা করে ওর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, বুড়ো মরছে না বলে। মদের ঘোরে। তারপর থেকেই মাঝরাতে ইদারার পাড়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে কাদত, বাবা, তুমি কী করছ ওখানে! উঠে এসো। তোমার জন্যে কাঠালি কলা এনেছি। ও তো আগে এইরকম ছিল না। মিলিটারিতে কাজ করত। এতখানি চেহারা ছিল। তারপর অসৎসঙ্গে পড়ে, মদ, ভাং, জুয়ায় এইরকম হয়ে গেল। আত্মহত্যাই করেছে ছোড়দা। মনটা তো খুব নরম ছিল।
আমরা আবার রাস্তায় এসে উঠলুম। আমাদের মুখ স্টেশনের দিকে। হরিশঙ্করের মুখ ছেড়ে আসা গ্রামের দিকে। ছোটদাদু ভাবলেন হরিশঙ্কর দিক ভুল করেছেন। বললেন, তুই যে উলটো দিকে চললি। স্টেশন তো এই দিকে!
হরিশঙ্কর চলা শুরু করে দিয়েছেন। চলতে চলতে বললেন, দিক ভুল করিনি। যেদিকে যাওয়ার সেই দিকেই চলেছি। ফলো মি।
ছোটদাদু ভীষণ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করতে চাইছে বলো তো?
কিছুই বুঝতে পারছি না।
এতক্ষণ ধরে এতভাবে বোঝালুম, কিছুই ঢুকল না কানে!
দ্রুত এগিয়ে গেলেন ছোটদাদু, কী করতে চাইছিস?
হরিশঙ্কর বললেন, তুমি মামলায় হেরে গেছ। আমাকে অনুসরণ করো।
অনুসরণ করে?
সোজা থানায়। আমরা ছ’জন। ওরা ছিল দু’জন। এখন একজন। একা সেই ভৈরবী। আমরা হেরে যাব? তোমাকে দেখাতে চাই, সত্যের জয়। তুমি ধার্মিক, ঐশী শক্তির অধিকারী। তোমাকে দেখাতে চাই ধর্মের জয়। চোরের মতো পা টিপে টিপে পালাব। পালিয়েও শান্তি নেই, সর্বক্ষণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এই বুঝি পুলিশ এল। ধরে নিয়ে গেল খুনের দায়ে। তোমার কোনও ভয় নেই। আমার সঙ্গে চলো। আমার আত্মবিশ্বাস জয়ী হবেই। আমি যদি এই সিচ্যুয়েশন ফেস না করি, আমার বিবেক আমাকে সারাজীবন ঘুমোত দেবে না। বিবেক হল মেরুদণ্ড। তোমার এত কেন ভয়!
ছোটদাদু কিছুক্ষণ গুম মেরে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক বলেছিস। ভীরুতাই পাপ। ভীরুতাই অধর্ম। যা হবার তা হবে। চলো, লেট আস ফেস দি সিচুয়েশন।
আবার মাইল দুয়েক হাঁটতে হবে ভেবে আমার কান্না পেয়ে গেল। সারারাত জেগে। চান হয়নি। দানাপানি পড়েনি পেটে। রোদে সব ঝলসে যাচ্ছে। এই উদ্বেগ, এই উৎকণ্ঠা। জীবনের এইসব মুহূর্তে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। ঘটনা থেকে পালাতে না পারলে দেহ থেকেই পালানো ভাল। সে উপায়ও তো নেই। মৃত্যু ও হরিশঙ্কর সমান একগুঁয়ে। কারও কথা শোনে না। থানা, হাসপাতাল, সরকারি দপ্তর, কোর্টকাছারি, আমার ভেতরে অদ্ভুত এক অসুস্থ ভাব আনে। কী কুক্ষণেই আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম। ছোটদাদু এমন একজন অলৌকিক পুরুষ। মা কালীর সঙ্গে যার সরাসরি যোগাযোগ, তার শক্তিও বেকায়দা। মানুষ যে-ঘটনা ঘটাবে, যে-চক্রান্তে ফেলবে, সেখান থেকে বের করার ক্ষমতা ভগবানের নেই। ভগবান অতিশয় শৌখিন এক বড়বাবু। সুখীর সঙ্গ করেন। যে-মানুষ বিপদে পড়েছে তাকে বিপদের বিচারেই ছেড়ে দেন। ভাল যার হয় তার নিজের শক্তিতেই হয়। আশ্রমের ছবি মন্দিরের ছবি চোখের সামনে ভাসছে। একদল আর্ত কাতর নরনারী। জীবনের মুড়ো ঝাটায় ক্ষতবিক্ষত। মন্দির, দাঁতব্য চিকিৎসালয়, বড়লোকের চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, এক চেহারা। মানুষ চাইতে এসেছে। শেষের দুটোয় তবু কিছু মেলে। প্রথমটায় সবই ফক্কা। বসে বসে নিজের বুড়ো আঙুল চোষো।