তুমি খুন ভাবছ কেন? অ্যাক্সিডেন্টালি পড়ে যেতেও তো পারে!
ভুলে যেয়ো না আশা বসে আছে শত্ৰুপুরীতে। জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি অতি ভয়ংকর জিনিস। মানুষের আদিম লোভের একটি। এই মৃত্যুর পর এদের জমিজমার কে মালিক হবে? কে হতে চলেছে। তোমাকে একটা কথা বলি, মানবতা, কর্তব্য এইসব ভুলে, এখনই যে যে-অবস্থায় আছ। বেরিয়ে পড়ো, বাঁচতে যদি চাও। বিশাল বিশ্রী এক ঝামেলা আসছে। হরিশঙ্কর, জেল জিনিসটা খুব সুখের নয়। জায়গাটাও খুব খারাপ। স্বদেশি করার সময় আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল এখনও কেউ আসেনি। আগে এখান থেকে বেরিয়ে চলো, তারপর বলব চক্রান্তটা কী? আমি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমার অনুমান মিথ্যে হবার নয়।
হরিশঙ্কর ভয়ংকর অবাক হয়ে বললেন, সেকী পালিয়ে যাব? ভয়ে পালাব?
ছোটদাদু বললেন, কার ভয়ে তুমি পালাচ্ছ হরিশঙ্কর! কেউ কি তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?
মানুষ নয়, ভয় দেখাচ্ছে আশঙ্কা।
তুমি ভয়ে পালাচ্ছ না, পালাচ্ছ বুদ্ধিমান বলে। নির্বোধ নয় বলেই আমরা ফাঁদে পা দিচ্ছি না।
আমরা অপরাধী নই, তবু একদল খুনির মতো বেরিয়ে এলুম সেই ভিটে ছেড়ে। কেবলই মনে হচ্ছে, কেউ দেখছে না তো! কেউ হঠাৎ জিজ্ঞেস করবে না তো, যাচ্ছ কোথায়? কেউ ফিরে তাকালে অস্বস্তি হচ্ছে।
ছোটদাদু বললেন, ভাগ্যের পরিহাস। সত্যিই আমাদের অপরাধীর মতোই পালাতে হবে। কারও চোখে যেন না পড়ে যাই। একটু ছাড়া ছাড়া ইটো সবাই। দল তৈরি কোরো না।
হরিশঙ্কর বললেন, আবার কি আমাদের হেঁটেই যেতে হবে? জঙ্গলের পথ ধরে!
না। ও পথের শেষ মাথায় অমঙ্গল বসে আছে। এবার আমরা রেলে ফিরব।
স্টেশনের দিকে এগোেলুম আমরা। আমাদের নিয়ে কারওই তেমন মাথাব্যথা নেই। আমরা চলেছি আমাদের মতো। মনে কিন্তু অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করছে। মৃত্যু মানুষকে কেন এত ভয় দেখায়?
২.৪৭ An animal with some instincts of a God
হরিশঙ্কর বেশ নিজের মনেই হাঁটছিলেন, হঠাৎ থেমে পড়লেন। পাদমেকং ন গচ্ছামি। ছোটদাদু বললেন, আবার কী সমস্যা?
হরিশঙ্কর বললেন, কোনও পরিস্থিতি থেকে কখনও আমি পলায়ন করিনি, আর সবচেয়ে বড় কথা হল, টুথ ইজ টুথ। সত্য হল, আমরা খুনি নই, তা হলে আমরা কেন সিচুয়েশন ফেস করব না! দিস ইজ কাওয়ার্ডিস!
ছোটদাদুর মুখে খেলা করে গেল সেই উদ্ভাসিত হাসি। আমরা গ্রামের সীমানার বাইরে চলে এসেছি। মন্দির, মসজিদ, পাম্প হাউস সব পেছনে ফেলে এসেছি। ফেলে এসেছি সায়েবকুটি বলে বিশাল এক বাগানবাড়ি। স্বদেশি আমলের চরকা প্রতিষ্ঠান। এখন যেখানে মেয়েদের তাঁত শেখানো হয়। হাতের কাজ শেখানো হয়। স্বদেশি কাগজ আর সাবান তৈরি হয়। সব পেছনে ফেলে এখন আমরা শুধু প্রান্তরে। রোদে চারপাশ দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী দুর্গতি আমাদের! চামড়া পুড়ে কালো হয়ে আসছে।
ছোটদাদু বললেন, আমরা ওই ছায়ায় একটু বসি। তোদের একটু বোঝানো দরকার পরিস্থিতিটা কী দাঁড়িয়েছে। খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়।
বাঁ পাশে মাঠের মাঝখানে ঝকড়া একটা গাছ। ভাঙা একটা ঘর। কোনও সময় কিছু একটা ছিল। আমরা সেই দিকে এগিয়ে চললুম। হরিশঙ্কর লক্ষ্মী ছেলের মতো কেন এগিয়ে যাচ্ছেন আমি জানি। ওই ভাঙা বাড়ি। একটা সমাধি মতো রয়েছে পাশে। অতীত ডাকছে ইশারায়, ডাকছে অখ্যাত ইতিহাস। কেউ ছিল একদিন। কে তিনি? হরিশঙ্করের জানা চাই। লতাপাতার ইতিহাসে পড়ে আছে কারও পরিত্যক্ত সংসার। আমরা সকলেই বসে পড়লুম হরিশঙ্কর ছাড়া। তিনি সেই ভগ্ন কুটিরের ইতিউতি উঁকি মারতে লাগলেন।
ছোটদাদু বললেন, তুই তাড়াতাড়ি তোর অনুসন্ধান শেষ করে এদিকে আয়।
হরিশঙ্কর খুঁজে খুঁজে ঠিক একটা প্রস্তরফলক আবিষ্কার করলেন। উদ্ভাসিত মুখে বললেন, পেয়ে গেছি। সবই অস্পষ্ট, নামটা কোনওরকমে পড়া যায়, স্বামী তপানন্দ। এখানেও সন্ন্যাসী। ধর্মের এলাকা থেকে বেরোবার উপায় নেই। যেদিকেই যাও ধর্ম।
ছোটদাদু বললেন, বেশ হয়েছে, এখন চলে এসো।
হরিশঙ্কর এসে বসেই বললেন, তপানন্দ কে?
ছোটদাদু বললেন, নিশ্চয় কোনও সন্ন্যাসী।
তার চেলারা কোথায়? এইভাবে একটা সাধনপীঠ নষ্ট হয়ে গেল!
কত পীঠ এইভাবে নষ্ট হয়, ও নিয়ে মাথা খারাপ করার দরকার নেই। তুমি আসল সমস্যায় এসো।
হরিশঙ্কর গুছিয়ে বসলেন। ছোটদাদু পিসিমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আশা, তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল, তুই তোর ঠাকুরপোকে ঠেলে ফেলে দিসনি তো?
হরিশঙ্কর লাফিয়ে উঠলেন, সে কী? আশা ঠেলে ফেলবে কেন? আশা খুনি? অসম্ভব! তুমি ভুল পথে যাচ্ছ। ঠিক হচ্ছে না।
পিসিমার মুখ ভয়ে সাদা। থেমে থেমে বললেন, এ তুমি কী বলছ ছোটমামা! অত বড় একটা মানুষকে ঠেলে ফেলা সম্ভব!
মাতালকে ফেলা সম্ভব। বিয়ের আগে পর্যন্ত তুই ডাকাবুকো ছিলিস। সত্যি কথা বল। তুই খুব রাগী। রেগে গেলে তোর জ্ঞান থাকে না। একবার তুই আমাদের জানলার গরাদ বাঁকিয়ে দিয়েছিলিস।
পিসিমা ছোটদাদুর গায়ে হাত দিয়ে বললেন, বিশ্বাস করো, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি কিচ্ছু জানি না।
তুই কোনও শব্দ পাসনি।
সত্যি পাইনি।
ছোটদাদু ছেলে আর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা কোনও শব্দ পাসনি?
তিনজনেই বললে, না। কোনও শব্দ শোনেনি।
হরিশঙ্কর বললেন, তুই কোনও ক্রিমিন্যাল ল-ইয়ার হলে মিজারেবলি ফেল করতিস। এটা একটা জেরা হচ্ছে?