সকালে বেশ করে তেল মেখে চান। পাট করে আঁচড়ানো চকচকে চুল। পেটের কাছে পাট করা কোঁচা। গায়ে কামিজ। সাদা কাপড়ের ব্যাগে টিফিন কৌটো। ভেতরে আধডজন রুটি, একদা কুমড়োর ঘাট। কত্তা চললেন অফিসে৷ দুগগা দুগগা। সবচেয়ে ছোটটা দোরগোড়া থেকে চেল্লাচ্ছে, বাবা, থিগিগর থিগিগর আছবে। এই কত্তাই বিয়ের ভোজে বসে চিৎকার ছাড়ছেন, মাছটা আর একবার ঘুরিয়ে দাও। দইয়ের মাথা, দইয়ের মাথা। লেডিগেনিটা আর একবার। মন্দিরে গিয়ে ঠ্যাং ঠ্যাং করে ঘণ্টা বাজিয়ে বিকট ডাক, মা, মা, জগদম্বে! বুউ উ উ বুম, ব্যোম, শিব শ্যাম্ভ। চোখ উলটে কয়েক সেকেন্ড দণ্ডায়মান। তারপর হনহন করে ছুটছেন পাঁচুর পেছনে বাঁশ দিতে।
মন ভেবে দেখ, তুই কি ওইরকম হতে চাস? মন বললে, না। তা হলে? মামার সঙ্গে নিজাম ফ্যামিলির এক আত্মীয়ের বাড়িতে গানের আসরে গিয়েছিলাম। মামার সে কী সুন্দর পোশাক! গলাবন্ধ সিল্কের ঝকঝকে কোট। পা-চাপা পাজামা। সোনার চেন ঝুলছে বুকপকেটের কাছে। চোখে রিমলেস চশমা, মিহি আতরের গন্ধ। চলার মধ্যেও একটা হালকা নাচের ছন্দ। নবাব। পরিবারের বিরাট গাড়ি চেপে আসরে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দুটি মেরু, হয় রাজা না হয় মহারাজ। মহারাজ মানে সন্ন্যাসী। এর মাঝে যা কিছু সবই উঞ্ছবৃত্তি। ইয়া পুরু কার্পেট মোড়া বিশাল হলঘর। ঝাড়লণ্ঠনের ঝাড় দেখে মাথা ঘুরে যায়। বেনারসি কেটে জানলার পরদা হয়েছে। বাড়ি বললে ভুল হবে। প্যালেস। গৃহস্বামীর গায়ের রং চাপাফুলের মতো। পোশক রূপকথার মতো। আর সেই বাড়ির মহিলারা! স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। একঝলক দু’ঝলকের দেখা। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডিমের মতো মুখ। খাড়া খাড়া নাক। পটলচেরা চোখ। দুধেআলতা রং ধনুকের মতো বাঁকা বাঁকা ভুরু। এমন পরিবেশ, এমন আদবকায়দা-নড়তেচড়তে ভয় লাগে। আমার মাতুলের এসব রপ্ত ছিল। গান ধরলেন যমুনা কা তীর। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হল, চাঁদের আলোয় তাজমহল তৈরি হচ্ছে। স্বয়ং সাজাহান বসে আছেন আরাম চেয়ারে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে ধীরে ধীরে নাচাচ্ছেন। নাগরার জরি তারের আগুনের মতো চমকে চমকে রিরি করে উঠছে। কফিনের ডালা খুলে মমতাজ আসছেন চাঁদের আলোর পোশাক পরে। সেদিন যমুনার তীর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে কেবলই মনে হয়েছিল, ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করলে মন্দ হয় না। এই শেরোয়ানি, এই আচকান, এই আতরদান, এই মলমল, মখমল, মেহেন্দির আলপনা আঁকা চাঁপার কলি আঙুল, সুরমা-টানা তীক্ষ্ণ চোখ, উর্দু শায়ের। মসজিদ উঠে গেছে আকাশের চাঁদোয়ায়, আজানের শব্দ। রোগনজুস থেকে ভেসে-আসা জাফরান আর আতরের গন্ধ। না, ধর্ম বদলালে কিছু হবে না। চালকলা বাঁধা বামুনের রক্তে রং ধরবে না। চ্যাটাই পেতে মেটে দাওয়ায় আড় হয়ে শুয়ে আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহ চ্যাটাস চ্যাটাস করে মশা মারতেন আর প্রপিতামহীকে গালাগাল দিতেন। সকালে ফতুয়া পরে বগলে রংচটা ছাতা নিয়ে পাঠশালে গিয়ে বাঁদরদের শুভঙ্করী শেখাতেন। সকালের নাস্তা বেগুনপোড়া দিয়ে একবাটি মুড়ি। বড়াখানা আলোচালের পিন্ডি, কঁচকলা ভাতে, পপিতা সেদ্ধ, থানকুনি পাতার ঝোল, হিংচে শাক। তস্য পিতা উদুখলে চালভাজা গুঁড়ো করে ফোকলা মুখে ফকফক করে খেতেন। বুড়ি বুড়োকে গালাগাল দিয়ে বলতেন, মরবে এইবার পেছন পটকে। মাঝে মাঝেই পরিবারে চালু নানান চুটকির মধ্যে যেটি কানে আসে, খুব সূক্ষ্ম নয় স্থূল, যথা: পণ্ডিতং পণ্ডিতং মুখ কেন সিটকেতং? উত্তর, কেঁচায় পট্টতং। প্রশ্ন, যাও না কেন নদী? উত্তর, বাকি আছে। দধি। সেই রক্তে কি আর পারস্যের বুলবুল গান গাইতে পারে? তৈমুর কি চেঙ্গিজের সন্তান হলে দেখা যেত। এ তো অসি ধরা মেজাজ নয়। মসি ধরে চলে আসছে জীবিকার ধারা। গাড়ু হাতে মাঠ। ভেঙে প্রাতঃকৃত্য। কেঁতা বগলে শয়ন। দাঁতন মুখে প্রভাতে উত্থান।
রক্তে যদি গানের বীজ থাকত তা হলে একবার চেষ্টা করে দেখতুম। মামার মতো ক্ল্যাসিক্যাল মেজাজ নিয়ে রাজা মহারাজার বাড়িতে আসর মারতুম। সুরের পথ বেয়ে বেয়ে চলে যেতুম অতীতের ঐশ্বর্যে। মামার মতো ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঘাড়ের কাছে বাবরি। আঙুলে হিরের আংটির ঝিলিক। চারপাশে সুন্দরী। দিনকতক মামার কাছে তালিম নিতে বসলুম। প্রথমেই গলা সাধা। ভূপালি, এ তানা যোবানা পরমা নানা করিয়ে। কেঠো সুর। অর্ধেক পরদা লাগে না। এ তানা যোবানা পরমা, একটু থমকেই সপাট তান, সারে গাপা ধাসা, গাপা গারে সা, হাঁটুতে এক চাপড়, এ তানা। যোবানা। সেই অঙ্কের ব্যাপার। ফাঁক, সম। তিন তালের তা ধিন ধিন তা, তা তিন তিন তা। লয় চলেছে টুকুস টুকুস। যে যেখান থেকে পেরেছে পৃথিবীটাকে জটিল করে রেখেছে। গলা শুনে গুরু বললেন, হচ্ছে, তবে নাকি সুর এসে যাচ্ছে দোক্তা বাঁড়ুজ্যের মতো। ভদ্রলোকের আসল নাম লোকে ভুলে গেছে। পানদোক্তা ঠেসে গান ধরেন, সোনে কা থালমে খা রাহি হ্যাঁয়, এ কালী কমলি সুঘারা। বানাও। চড়ার দিকেই যত গোলমাল। পাঠাকাটা গলা। তালে লয়ে মাস্টার। স্টক অনেক। শুধু গলা নিয়েই গণ্ডগোল। গলা কাটা গাইয়ে।
মামা বললেন, তোর ন্যাক আছে। থাকতেই হবে। আমাদের বংশের ব্লাড ঘুরছে শরীরে। তবে সাধতে হবে। বারো ঘণ্টা, তেরো ঘণ্টা। সারে, গাপা, ধাসা, ধাপা, গারে, গাসা। আর ওই নাকটাকে বাদ দিতে হবে। ওই তানা পরমা না না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সামনে আধ হাত জিভ বের করে সিংহের মতো আ আ করবি। একগলা জলে দাঁড়িয়ে নাদ সাধনা করবি হুম, হুমমম। সংগীত মানে নাসিকাবাদ্য নয়, গলা বাজানো।