ফিরোজা বোধ হয় বেশ এগিয়ে গেছে, অত্ত্বিকটির সাথে এক চাইনিজে তাকে: দেখেছে আমার এক বন্ধু, মোসলেম আলি, ফিরোজার এক অপ্রকাশিত অনুরাগী; আমাকে টেলিফোন না করে উত্তেজিত হয়ে আমার অফিসে এসেছে এক সন্ধ্যা একরাত কষ্টে নিজের উত্তেজনা চেপে রেখে। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিলো তার বউ ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে গেছে, সে লাফিয়ে পড়তে পারে সাততলা থেকে। ফিরোজা তাকে চিনতে পারে নি, না চেনার ভান করেছে, এতে সে আরো বিপর্যস্ত হয়ে গেছে, এবং আমার জীবনে যে একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এতে সে কাতর হয়ে পড়েছে। মোসলেম আলিকে আমি পছন্দ করি; সে আমার একনিষ্ঠ অনুরাগী নজরুল ছাত্রাবাসে। ঢোকার পর থেকেই;–আমি যদি মহাপুরুষ হতাম তাকে পেতাম প্রথম বিশ্বাসীরূপেই; সে আমার কাছে নিয়মিত স্বীকারোক্তি করে চলতো তার সমস্ত পাপের, যেনো আমি। কোনো পুরোহিত, তাকে পাপমুক্ত করার জন্যে প্রার্থনার অধিকার আমার রয়েছে। সে একদিন এসে কাঁদতে থাকে আমার কাছে, খুব গোপনে; বারবার মাফ চাইতে থাকে। আমি তার কাছে জানতে চাই সে এমন কী অপরাধ করেছে, যে এতোটা ভেঙে পড়েছে, মাফ চাচ্ছে; সে পাপীর মতো জানায় সে আর সহ্য করতে পারে নি, মাসের পর মাস সহ্য করেছে, আত্মদমনের অনেক চেষ্টা করেছে, শয়তানটিকে পাজামার রশি দিয়ে বেঁধেও রেখেছে, আর পারে নি, শেষে আর্কিটেকচারের ওয়াজেদাকে ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে একটি কাজ করে ফেলেছে। তার পাপের শেষ নেই। তার দু-একদিন পরই মোসলেম আলি তবলিগে যোগ দিয়ে এক মাসের জন্যে টঙ্গি চলে যায়, এবং তিন মাসের মধ্যে মামাতো বোনকে শাদি করে, এবং দশ মাসের মধ্যে প্রথম পুত্রটি পয়দা করে। ফিরোজার যে সে অপ্রকাশিত অনুরাগী, এটা সে কখনো আমাকে বলে নি, ফিরোজাই বলেছে আমাকে; আমি বুঝি ফিরোজাকে মনে রেখেও মাঝেমাঝে সে তার স্ত্রীর সাথে কাজটি করে। মোসলেম আলি আমার জন্যে ভয়াবহ সংবাদ নিয়ে এসেছে; সে নিশ্চিত আমার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
ভাবী আমারে চিনতে পারল না, মোসলেম আলি বলে, তাইতেই আমি বুঝছি এইতে একটা কিন্তু আছে।
তোমার কী মনে হয়? আমি বলি।
যা মনে হয়, মোসলেম আলি বলে, তা আমি তোমার স্ত্রী আর আমার ভাবীর। সম্পর্কে বলতে পারব না। মোসলেম আলি বিমর্ষ হয়ে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর বলে, তোমাগো সংসার কি ভাল যাইতেছে না?
আমি বলি, ভালোই তো যাচ্ছে, কোনো মারামারি নেই।
মোসলেম আলি বলে, আমার কথা শুইন্যা আইজ মারামারি করবা না?
আমি বলি, না।
মোসলেম আলি বলে, এইর লিগাই মাইয়ালোকগুলি এমন হইয়া যাইতেছে। আমি হইলে আইজ বানাইতাম, পরপুরুষের লগে চাইনিজে যাওয়া দেখাইতাম।
আমি বলি, এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে?
মোসলেম আলি বলে, তুমিও আবার পরের মাইয়ালোকের লগে যাও কি না কে জানে।
মোসলেম আলি চলে যায়, আমি একটু বিমর্ষ বোধ করি; আমার ইচ্ছে হয় অনন্যার কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি যদি একটি রিকশা নিয়ে ওর কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়াই, অনেকক্ষণ দাঁড়াই, দাঁড়িয়ে এবং দাঁড়িয়ে এবং দাঁড়িয়ে থাকি, কলেজ থেকে বেরোতে গিয়ে অনন্যা যদি দেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি সে কতোখানি চমকে উঠবে? কততখানি বিহ্বল হবে? কতোটা ভয় পাবে? আমাকে কি চিনতে পারবে? আমি কি কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়াতে পারি? গাড়ি নিয়ে গেলে তোকজন ভাববে আমি আমার কন্যাকে নিতে এসেছি; কন্যাকে নেয়ার জন্যে কেউ কি এতো আগে গিয়ে গেইটে বসে থাকে? আমি কি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না? কিন্তু আমি বেরোবো কেমনে? অনেকগুলো শেকল খুলে আমাকে বেরোতে হবে; ব্যক্তিগত সহকারিণীর শেকল খুলতে হবে, তিনজন অধস্তনের শেকল খুলতে হবে, তা আমি খুলতে পারবো; কিন্তু ড্রাইভারের শেকল খুলবো কীভাবে? যদি আমি আমার গাড়িতে না উঠি, পথের দিকে হাঁটতে থাকি, প্রথম আমার ড্রাইভার পাগল হয়ে যাবে, সাথে তার আরো দশটি সঙ্গী পাগল হবে, ওরা সবাই মিলে আমাকে পাগল মনে করবে। মনে। করবে আমি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছি; একটি মেয়ে যে আমার কাছে এসেছিলো এটা সম্ভবত এখন তাদের আলোচনার বিষয়, এবং তারই ফল ফলছে মনে করে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে। নানা দিকে সংবাদ পৌঁছে যাবে, আমার বাসায়ও পৌঁছোবে। আমি এমন। সংবাদের বিষয় হয়ে উঠতে পারি না। অনন্যার কলেজের গেইটে আমার যাওয়া হবে না, আমি এতোটা সাহসী হতে পারবো না। তখন মাহমুদা রহমানের ফোন বাজে;–অনেক দিন পর মাহমুদা রহমান, তিনি জিল্লুর রহমান হয়ে গেছেন কি না জানি না, কিন্তু তার ফোন উদ্ধারের মতো মনে হয়। আমি কি খুব শূন্যতার মধ্যে আছি, কোনো কৃষ্ণ গহ্বরে পড়ে গেছি? নইলে ওই ফোনকে উদ্ধার মনে হচ্ছে কেনো? কিন্তু না, উদ্ধার নয়, বরং মাহমুদা রহমানই আমাকে অনুরোধ করছেন তাকে উদ্ধার করতে। আমি ভাঁকে। উদ্ধার করবো? তিনি কি আরো গভীর গর্তে পড়েছেন? এখনই তাঁর বাসায় যেতে হবে আমাকে; তার কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর সমস্ত হাহাকার, সমস্ত ক্রোধ, সমস্ত ঘৃণা।
মাহমুদা রহমানের বাসায় গিয়ে দেখি হাফিজুর রহমান ফিরেছেন আল মদিনা থেকে; তিনি আমাকে দেখে বসা থেকে উঠলেন না, আমি যে হাত তুলোম তার কোনো উত্তর দিলেন না, একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে রইলেন। তিনি কি জেনে গেছেন তার স্ত্রীর সাথে আমার একটা শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাই ছুটে। এসেছেন সৌদি থেকে? কিন্তু তার মুখে কোনো ক্রোধ দেখছি না, আমাকে দেখে ফেটে পড়ার ভাব দেখছি না, এখনই যে উঠে স্ত্রীকে চুল ধরে টেনে আমার সাথে ঘরের বাইরে বের করে দেবেন, তাও মনে হচ্ছে না; বরং তাকেই মনে হচ্ছে অপরাধী, তিনি মাথা নিচু করে বসে থাকার চেষ্টা করছেন। আমি তাকে কুশল জিজ্ঞেস করি, তিনি। মাথা নিচু রেখেই উত্তর দেন; আমার সম্পর্কে কোনো উৎসাহ দেখান না। তাহলে উদ্ধার করতে হবে কাকে, মাহমুদা রহমান না হাফিজুর রহমান না আমাকে?