তারপর মনে হতে থাকে আমি যে গুরুত্বপূর্ণ হতে চাই নি অনন্যার কাছে, নিজেকে গুরুগম্ভীর আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেখাতে চাই নি দেশের একটি বড়ো নির্মাণ। লিমিটেডের, ভালোই করেছি; আমি চল্লিশোত্তরতার ভার অনেকটা কমাতে পেরেছি, অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছি। এজন্যেই আমার খুব ভোরে ঘুম ভাঙছে, ঘুম ভাঙার সময় বুঝতে পারছি না আমি কোথায়, কোনো গ্রামে না শহরে না কোথায়, বুঝতে পারছি না। আমি কে, কোনো কিশোর না যুবক না বৃদ্ধ, এটা আমাকে সুখ দিচ্ছে। পর দিনই অনন্যা টেলিফোন করেছে; এটা অন্য এক জগতের টেলিফোন, তার কণ্ঠস্বর ভিন্ন, অভিধান আর বাক্য ভিন্ন, যার সাথে খাপ খাওয়াতে আমার বেশ কষ্ট পেতে হচ্ছে। আমি বিস্মিত হয়েছি যে শুধু আমারই বয়স বাড়ে নি, আমার ভাষারও বয়স বেড়েছে, আমার মতো আমার ভাষারও বয়স কমাতে হবে, যদি আমি অন্য জগতের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তাকে টেলিফোন করি নি, আমার সাহস হয় নি; বয়স হলে নানা রকম ভয় দেখা দেয়, আমারও তাই হয়েছে; কিন্তু কম বয়সের দারুণ দুঃসাহস রয়েছে, অনন্যা পরপর চারদিন ধরে টেলিফোন করছে, আমি অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছি। আমি আজকাল আটটার মধ্যেই অফিসে পৌঁছে যাচ্ছি, আটটা দশের মধ্যেই তার টেলিফোন বেজে উঠছে, পনেরো মিনিটের মতো কথা বলছি আমরা; এর মধ্যে সে আমার সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে গেছে, আমি শুধু একটি বৃত্তান্তই জেনেছি সে এক কলেজে এক বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছে। টেলিফোনে আমরা কী কথা বলতে পারি? অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা, ছেলেমেয়ের অসুখ, খুনজখম, আধুনিক সাহিত্য, সমান্তরাল সিনেমা, ধর্ষণ, ব্ল্যাক হোল, মেয়েমানুষের মন্ত্রীত্ব, পুরুষের পুঙ্গবতা? না কি কাতর কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা মেঘলা পানি পানি পচে-যাওয়া শবরি কলা ধরনের কথা? আমাদের দুজনেরই মনে হয় বিষণ্ণ। হওয়ার, টেলিফোনে, সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে লঘু পরিহাসে ভেসে যাওয়া। আমি তার সমাজসংসার বংশ পিতামাতা সম্পর্কে কিছুই জানতে চাই নি, ওগুলোতে আমার কোনো আগ্রহ নেই; এবং আমি জানতে চাই নি সে বিবাহিত কিনা। এতে সে বিস্মিত হয়েছে; তার সাথে দেখা হওয়ার পরই নাকি লোকেরা তার যে-সংবাদটি জানতে চায়, যে-সংবাদটি না জানলে তাদের কিছুই জানা হয় না বলে মনে হয়, তা হচ্ছে সে বিবাহিত কিনা। আমি যে ইচ্ছে করে ওই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছি, এমন নয়, আমার মনেই পড়ে নি; মানুষের যে একটি বিবাহগত গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি থাকে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তা আমার মনে পড়ে নি।
একদিন অনন্যা হেসে বলে-বিষণ্ণ হওয়ার এটা তার প্রিয় পদ্ধতি, আপনি কিন্তু আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি জানতে চান নি, দেখা হলেই যা সবাই জানতে চায়।
আমি বলি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ? আমি বুঝতে পারছি না, সেটা কী?
অনন্যা বলে, আমার বিয়ে হয়েছে কি না? না হলে কেননা হচ্ছে না?
আমি বলি, এটাই সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ সংবাদ?
অনন্যা বলে, হ্যাঁ, মেয়েদের সম্পর্কে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
আমি বলি, যে-পদার্থবিজ্ঞান পড়ায় তার সম্পর্কেও এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ?–অনন্যা বলে, মেয়েদের বেলা পদার্থবিজ্ঞানে আর গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে কিছু আসে। যায় না, আসে যায় বিবাহে ও অবিবাহে।
আমি বলি, তুমি কী উত্তর দাও?
অনন্যা বলে, আপনি কি আজই আমার উত্তরটি শুনতে চান?
আমি বলি, যদি কোনো অসুবিধা না থাকে।
অনন্যা হাসে, এবং বলে, আগে বলতাম বিয়ে করবো না-বলা উচিত ছিলো বসবো না; তাতে ঝামেলা বেড়ে যেতো, কেনো বিয়ে করবো না অর্থাৎ বসবো না তা সবাইকে। বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে হতো।
আমি বলি, এখন কী বলে?
অনন্যা বলে, এখন বলি পাত্র পাচ্ছি না। আর অমনি নতুন ঝামেলা বেঁধে যায়, কেউ সেনাবাহিনী থেকে মেজর, কেউ হাইকোর্ট থেকে বিপত্নীক বিচারপতি ব্যারিস্টার নিয়ে আসে; কলেজের আয়ারাও পাত্র নিয়ে আসতে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যে ইলেক্ট্রিশিয়ান।
আমি বলি, চমৎকার পাত্র, এবং একটু থেমে বলি, উচ্চরক্তচাপসম্পন্ন হৃদরোগসমৃদ্ধ দু-একটি কি আমিও নিয়ে আসবো?
অনন্যা বলে, ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ; সে হাসে, আমি কান পেতে শুনি, এবং বলে, ইউনিভার্সিটিতে আমার তিনচারটি বন্ধু ছিলো, ওদের সাথে আমি কার্জন হলের ঝোঁপের পাশে বসতাম, ওরা গাঁজা খেতো, আমি পড়তাম।
আমি বলি, পড়তে কেনো, গাঁজা খেতে পারতে।
অনন্যা বলে, আমি খেতে চাইতাম, ওরা দিতো না। বলতো মেয়েমানুষের গাঁজা খাওয়া ঠিক না। কল্কেটা পুরুষের। ওরা প্রত্যেকেই মনে করতো একদিন আমি তাকে নিয়ে সংসার করবো, স্ত্রী গাঁজা খাবে এটা ওদের ভালো লাগতো না বোধ হয়।
আমি বলি, শত হলেও তারা সমাজপতি পুরুষমানুষ।
অনন্যা বলে, পাশ করার পর ওরা আমাকে বলতো তুই আমাদের কাউকে বিয়ে কর। আমি বলতাম তোদের চারজনকেই আমার বিয়ে করা উচিত, তোদের। চারজনকেই আমি বিয়ে করতে চাই। ওরা রেগে উঠতো। তখন আমি বলতাম আমি বিয়ে করবো না। ওরা চেপে ধরতো, ক্যান তুই বিয়া করবি না। আমার কোনো কথাই ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। শেষে রেগে বলতো, তোর তো একটা দ্যাহ আছে, তুই দ্যাহের ক্ষুধা মিটাবি কেমনে? আমি বলতাম, কেনো, তোদর মতো ব্রোথেলে গিয়ে। ওরা চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিতো।