না পারা এক ধারাবাহিক জ্বরের মতো কাজ করে, আমি ওই জ্বরে বছরের পর বছর ভুগেছি, আমার সে-সময়ের সমস্ত কাজে তার ছাপ লেগে আছে। সমস্ত কিছুর ওপর আমার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হতো তখন; চোখের সামনে যা কিছু পড়তো আমি চোখ দিয়ে, মনে মনে জিভ দিয়ে, চুষতাম। মাওয়া সড়কে কয়েকটি ব্রিজ আমি দেখাশোনা। করছিলাম, সেখানে পাথর ভাঙতো যে-মেয়েরা তাদের দু-তিনটিকে আমি দূর থেকে, জিপের জানালা দিয়ে, আমার চোখ দিয়ে চুষতাম। ওরা আমাকে পছন্দই করতো, আমি গেলেই সামনে এসে দাঁড়াতো, জিপের সামনে এসে দাঁড়াতো কখনো, আমি মনে মনে শোষণ করতাম, তারা কেউ তা জানতো না। আমার প্রতিটি লোমকূপ তখন শোষণের কৌশল শিখেছিলো। তারা কেউ যদি আমাকে ডাকতো, আমি সাড়া দিতে পারতাম না; প্রকৃতিকে ধন্যবাদ, তারা কেউ আমাকে ডাকে নি। কিন্তু মনে মনে আমি তাদের। বারবার, দিনে দুপুরে সন্ধ্যায় মধ্যরাতে ঘুমের ভেতরে ঘুমের বাইরে, উপভোগ করেছি। একটি মিশমিশে কালো মেয়েকে আমার কালো আগুনের মতো মনে হতো, তার শরীর থেকে কালো শিখা উঠছে আমি দেখতে পেতাম, ফিরোজার পাশে শুয়ে আমি ওই মেয়েটিকে রাতের পর রাত জড়িয়ে ধরেছি, তার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে তার প্রতিটি স্প্যান প্রতিটি ভিত্তিকূপ লেহন করেছি। তার দুটি পুরু ঠোঁট ছিলো, ফিরোজার তিনটি ঠোঁট জোড়া দিলেও অতোখানি হবে না; কথা বলার সময় হলদে রঙের একটি প্রচণ্ড জিভ বেরিয়ে আসতো তার মুখের ভেতর থেকে, মনে হতো একটা গোখরো বেরিয়ে আসছে তার গহ্বর থেকে। তাকে দেখলেই আমার মনে হতো একটি কয়লার পাহাড়ে আগুন লেগেছে, তার তাপ আমার মাংসে এসে লাগতো। আরেকটি মেয়ে ছিলো লাউয়ের ডগার মতো, ছেলেবেলায় আমি জাংলায় লাউয়ের ডগা দুলতে দেখেছি, ওই মেয়েটিকে দেখলে আমি জাংলাভরা লাউডগা দেখতে পেতাম; চারপাশ সবুজ মনে। হতো। আমি তাদের কথা ভুলে গেলেও হঠাৎ তারা আমার রক্তে এসে প্রবেশ করতো। একবার ডেন্টিস্টের চেয়ারে শুয়ে আমি কাতরাচ্ছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না, তখন ওই মেয়ে দুটিকে আমি দেখতে পাই; তারা পাথর ভাঙছে, দেখতে পাই কালো আগুন জ্বলছে, লাউডগা লকলক করছে; আমার যন্ত্রণা কমে আসে, আমার কেমন যেনো লাগতে থাকে, রক্ত ঘোলা হয়ে উঠতে থাকে, ডেন্টিস্ট যখন দাঁত তুলছিলো আমি এক প্রচণ্ড পুলকে চেয়ার উল্টেপাল্টে দেয়ার উপক্রম করি। ডেন্টিস্ট বিব্রত হয়ে বলেন, আমি খুব দুঃখিত, আমি খুব দুঃখিত; কিন্তু আমি তখন চোখ আর মেলতে পারি নি।
ফিরোজা ঘরে বসে পচতে পছন্দ করে; একটা কলেজে সে পড়াতো বিয়ের আগে, বিয়ের পরেই ছেড়ে দেয়, কারণ ভবিষ্যতে তো ছেড়ে দিতেই হবে, সংসার দেখতে দেখতেই তার সময় কেটে যাবে; চাকুরি তার ভালো লাগে না। চাকুরি তার জন্যে জরুরি নয়, সেখান থেকে যা পাবে তাতে তার তেলের খরচও উঠবে না। বিয়ের পর কিছু দিন ধরে আমি অবশ্য একটা জোকের মতো লেগেছিলাম তার শরীরে; অসভ্য। কাজের পর অসভ্য কাজ করে সাধ মিটছিলো না আমার, ফিরোজারও অনেকটা। ফিরোজার শরীরটিকে আমার কাছে একটি বিস্ময়ের মতোই লেগেছিলো, তবে প্রতিবার অসভ্য কাজ করে আমি যেনো প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম কারো ওপর, হয়তো রওশনের। ওপর, মনে মনে বলছিলাম, দেখো, আমি এখন অসভ্য কাজ করছি, আমি ফিরোজার শরীর দেখছি, ঘূচ্ছি, তার ভেতরে যাচ্ছি, তার ওপর ঘুমিয়ে পড়ছি, রওশন তুমি এখন কোথায়! কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরোজা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
এসব আমার আর ভালো লাগে না, ফিরোজা বালিশ জড়িয়ে ধরে বলে, ঘুমোতে ভালো লাগে আমার এর চেয়ে, আমাকে ঘুমোতে দাও।
আমি হাত সরিয়ে নিই, দু-চার দিনের মধ্যে আর হাত বাড়াই না; বাড়াতে গেলেই আমার দ্বিধা লাগে, সাত-আট দিনের মধ্যে আর হাত বাড়াই না; বাড়াতে গেলেই দ্বিধা লাগে, দশ-পনেরো দিনের মধ্যে আর হাত বাড়াই না। ফিরোজা সুখে ঘুমোতে থাকে। ফিরোজা কেনো এতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তার কেনো ভালো লাগছে না? আমি কি পারছি না? আমি কি শুধুই বিরক্ত করি?
এই শোনো, আমি ডাকি, একটি রারার নামাবো?
ইচ্ছে হলে নামাও, ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে বলে ফিরোজা, বেশি বিরক্ত কোরো না।
বাক্স থেকে একটি রাবার নিয়ে এসে দেখি সম্পূর্ণ ঘুমিয়ে পড়েছে সে, আমিও শীতল হয়ে পড়েছি, সাপের রক্তের মতো ঠাণ্ডা আমার রক্ত; এখন আমাকে দশ হাজার ফিরোজা ডাকলেও আমি সাড়া দিতে পারবো না। বাথরুমে গিয়ে ফ্লাশ করে আমি রাবারটির ভার থেকে মুক্ত হই।
কলেজের কাজটি ফিরোজা ছেড়ে দিয়েছিলো আগেই। এখন তার আছে কর্মহীন সুখ, ঘুম, বেড়ানো, শাড়ির দোকান, বাপের বাড়ি, এই যাওয়া এই ফিরে আসা, আর। আমাদের ক্ষণিক আকস্মিক ক্লান্তিকর পরস্পরপীড়ন।
অধ্যাপনাটা তুমি না ছাড়ালেও পারতে, আমি কখনো বলি।
ওসব আমার ভালো লাগে না, ফিরোজা বলে, পড়ানোটড়ানো ভালো লাগে না।
শুনেছি মেয়েদের কলেজে না পড়ালেও চলে, মাঝেমাঝে গেলেই হয়, আমি বলি, তুমিও মাঝেমাঝে যেতে পারতে, অন্তত নতুন শাড়িগুলো দেখাতে পারতে মেয়েগুলোকে, ওরা ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত হতে পারতো।
তোমার বউ অধ্যাপিকা তুমি বলতে পারতে সকলকে, ফিরোজা বলে, বেশ লাগতো, কিন্তু আমার একদম ভালো লাগে না।