আমি বলি, তাহলে তোমার শরীর থেকে পুঁজ ঝরতে থাকবে, বিলকিস।
বিলকিস ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
ডলির বাবা আমার পাশে
ডলির বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়ান, এমনভাবে যেনো তিনি আমার বাবা; আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি সুখী বোধ করছেন; আমি যে নদীতে হারিয়ে যাই নি এটা তার জন্যে একটি গভীর সুখ। আমার মনে হয় এই প্রথম কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। দেলোয়ারের বাবা এমনভাবে দাঁড়ান নি, যদিও তিনি অনেক বছর ধরেই আমাকে স্নেহ করেন; আর ডলির বাবা হয়তো এর আগে আমাকে একবার দেখেছেন। তাঁর মুখে আমি প্রশান্তি দেখতে পাই।
তিনি বলেন, তুমি নেমেছিলে বলেই ডলি নেমেছিলো।
আমি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু নদীটাকে দেখতে পাই না।
তিনি বলেন, তোমার জন্যেই আমার মেয়েটি বেঁচে আছে।
আমি বলি, না।
তিনি বলেন, তুমি না নামলে ডলি নামতো না।
আমি বলি, আমার নামা ঠিক হয় নি।
তিনি বলেন, এ কী বলছো, বাবা?
আমি বলি, আমার বন্ধু মারা গেছে।
তিনি অপ্রতিভ হয়ে পড়েন, বিব্রত বোধ করেন; এবং বলেন, না, না; দেলোয়ারের জন্যে দুঃখের আমার শেষ নেই, সে আমার ছেলেই ছিলো, তবু।
আমি দেলোয়ারের মায়ের দিকে এগিয়ে যাই; তিনি আমার মুখের ওপর তার দুটি চোখ স্থির করে রাখেন।
আমি বলি, গাড়ি থেকে নেমে আমি অপরাধ করেছি।
তিনি কোনো কথা বলেন না; অন্যরা আমার চারপাশে ঘিরে আসে।
আমি আবার বলি, আমি অপরাধ করেছি।
আমি হাঁটতে থাকি; কারো দিকে তাকাই না; আমার পেছনে একটি নদী আছে, সে-কথা আমি ভুলে যেতে চাই; আমার পেছনে ডলি আছে, ডলির বাবা, মা আছেন, দেলোয়ারের বাবা, মা আছেন, অন্যরা আছে, ডুবুরিরা আছে, সে-কথা আমি ভুলে যেতে চাই। পোন্টুন থেকে হেঁটে আমি সড়কে উঠি; সড়ক ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে আমার ভালো লাগতে থাকে; আমার মনে হতে থাকে নদীর ভেতর থেকে, নদীর ভেতরে ডুবে-যাওয়া গাড়ি থেকে এইমাত্র আমি উঠে এসেছি; পরমুহূর্তে মনে হয় গাড়ি নিয়ে আমি ডুবে যাচ্ছি, গাড়ির কাঁচ ভাঙার জন্যে প্রচণ্ড চেষ্টা করছি, দেলোয়ার আমাকে জড়িয়ে ধরছে, তাকে ছাড়িয়ে কাঁচ ভেঙে আমি ওপরে উঠে আসছি; আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, আমার শরীরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি সড়কের পাশে বসে পড়ি; আমার ঘুম পায়।
মাঝরাতে আমি বাসায় ফিরলে মা বেশ অবাক হয়। এতো রাতে আমি অনেক বছর বাসায় ফিরি নি।
মা জিজ্ঞেস করে, কেমন বেড়ালি?
আমি বলি, ভালো।
আমার ঘরে গিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি; বিস্ময়কর ঘুম হয় আমার। এমন গভীর ঘুম আমার অনেক দিন হয় নি। আমার ঘুম হয়তো ভাঙতো না, বছরের পর বছর হয়তো আমি ঘুমিয়ে চলতাম, কিন্তু আমি ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই আমার দরোজায় কারা যেনো ভিড় করেছে, দরোজায় ভীষণ শব্দ করছে, আমাকে ডাকছে; আর আমার মনে হতে থাকে আমি পানিতে ডুবে গেছি, একটি বাক্সের ভেতর আটকে গেছি আমি, বাক্সটি আমি খুলতে পারছি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুম ভাঙলে আমি দরোজা খুলতেই সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমি জানতে চাই, কী হয়েছে।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে; ছোটো বোনটি আমাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকে। বাবার হাতে আমি সকালের কাগজটি দেখতে পাই।
বাবা জিজ্ঞেস করেন, ফিরে এসে কিছু বললি না কেনো?
আমি বলি, গাড়ি থেকে নেমে আমি অপরাধ করেছি।
মা কেঁদে ওঠে, কী বলছিস তুই, তাহলে তোকে আমি কোথায় পেতাম?
আমি গিয়ে আবার শুয়ে পড়ি; হাতের পাশে একটি পুরোনো প্লেবয় পাই। আমার ঘুমোতে ইচ্ছে করে না, আমি প্লেবয়ের পাতা উল্টোতে থাকি; মাঝের পাতাগুলোতে এসে প্লেমেইটটির ছবি দেখতে থাকি, মেয়েটির এতো কিছু এতো অপরূপভাবে আছে, মেয়েটির সব কিছু আমার ভালো লাগতে থাকে, তার শরীর থেকে মাংসমেশানো একটি সুগন্ধ এসে আমার নাকে লাগতে থাকে; আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে না। আমি অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটির ছবির ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকি; মেয়েটি জীবিত হয়ে উঠবে বলে আমার মনে হয়, ডলিকে আমার মনে পড়ে। দেলোয়ার নিশ্চয়ই ডলির বুকে মাথা রেখে এভাবে ঘুমোতে; আমি কখনো ঘুমোবো না, কেননা আমি কখনো বিয়ে করবো না, কেননা আমি অপবিত্র। হঠাৎ আমার মনে হয় আমি আর অপবিত্র নই, কেউ জানে না আমি অপবিত্র; দেলোয়ার জানতো, সে আর নেই; বিলকিসকে আমি একবার বলেছিলাম, কিন্তু আমার অপবিত্রতা তার কাছে পবিত্রতার থেকেও পবিত্র; আজ আর কেউ জানে না আমি অপবিত্র। দেলোয়ার কাউকে বলে নি বলে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। সে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলো, অন্য কারো কাছে সে আমার অপবিত্রতার কথা বলে নি। কেনো বলে নি? তাহলে আমি অন্যদেরও দেলোয়ারের মতো পবিত্র ভাবতাম বলে? অন্যদের সাথে দেখা হলে আমার কখনো অপবিত্রতার বোধ হতো না; হতো দেলোয়ারের সাথে দেখা হলে; দেলোয়ার আমার কাছে অন্যদের সমান হতে চায় নি বলেই হয়তো বলে নি। নিজেকে আমার হাল্কা লাগতে থাকে; এখন আমি আর কারো কাছে অপবিত্র নই। কিন্তু যে-মেয়েটিকে আমার ভালো লাগতো, আট বছর আগে, সে কোথায় আমি জানি না; সে তার মামার সাথে পালিয়ে গেছে, শুনেছি আমি; মেয়েটির মুখ আমি মনে করতে পারি না; কিন্তু আমার ভালো লাগতে থাকে। তার সাথে দেখা হলেও আমি অপরাধবোধে ভুগবো না।
দু-তিন দিন আমি ঘর থেকে বেরোই নি; বিছানা ছেড়েই উঠি নি। তারপর আমার বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বাসা থেকে বেরিয়ে বুঝতে পারি না কোথায় যাবো; তবে আমি একটি রিক্সা ডেকে ফেলেছি, রিক্সাঅলা আমার সামনে এসে থেমেছে, না থামলেই আমার ভালো লাগতো। রিক্সাঅলাকে ফিরিয়ে দেবো? লোকটি আমার দিকে কেমন করে তাকাবে না? আমি রিক্সায় উঠে বসি, রিক্সাঅলাকে আমি আজিমপুর যেতে বলি। আমার দেলোয়ারদের বাসায়ই যেতে ইচ্ছে করে। গেলেই হয়তো আমি দেলোয়ারকে দেখতে পাবো। রিক্সা থেকে নেমে আমি দেলোয়ারদের বাসার সামনে এসে দাঁড়াই; বাসার ঘণ্টা বাজাতে গিয়ে আমি থেমে যাই; সেখান থেকে নেমে এসে আমি রাস্তায় দাঁড়াই। তারপর আবার দেলোয়ারদের বাসার দরোজায় গিয়ে দাঁড়াই, আবার ঘণ্টা বাজাতে গিয়ে থেমে যাই; এবং রাস্তায় নেমে আসি। ওই মুহূর্তে আমার নারায়ণগঞ্জ যেতে ইচ্ছে করে, দেলোয়ারের সাথে একবার আমি যেখানে গিয়েছিলাম। আমি এখন যদি নারায়ণগঞ্জ যাই, দেলোয়ার তা জানবে না; আমি যে আবার অপবিত্র হয়ে গেছি, দেলোয়ার তা জানবে না; আমাকে বলতে পারবে না তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। একবার অপবিত্র হওয়ার পর কেউ কি দ্বিতীয় বার অপবিত্র হতে পারে, একবার চরিত্র নষ্ট হওয়ার পর কি দ্বিতীয় বার চরিত্র নষ্ট হতে পারে? আমার আর কিছু অপবিত্র হওয়ার নেই, আর কিছু নষ্ট হওয়ার নেই। আমি একটি রিক্সা নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে যাই, দেখি সেখানে কোনো ট্যাক্সি নেই; এখন আর ট্যাক্সি চলে না। আমার নারায়ণগঞ্জ যেতেই হবে, নারায়ণগঞ্জে আমার জরুরি কাজ রয়েছে, কাজটি আজ সন্ধ্যায়ই সম্পন্ন করতে হবে, নইলে আর করা হবে না; আমি একটি বেবি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে নামি। কিন্তু কোথায় যাবো? দেলোয়ার আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছিলো? আমার অপবিত্রতার পবিত্র তীর্থক্ষেত্র কোথায়? আমি জানি না। আমি একটি রিক্সা নিই, রিক্সাঅলা বারবার কোথায় যাবো জানতে চায়, আমি তাকে আমার গন্তব্য বলতে পারি না। আমি একেকটি অন্ধকার পথের মোড়ে এসে রিক্সাঅলাকে ঢুকতে বলি, তারপর আরো অন্ধকার একটি গলি খুঁজি, সেই গলি পাই না; তখন তাকে আমি অন্য দিকে যেতে বলি; আবার কোনো অন্ধকার পথের মোড়ে এসে তাকে ভেতরে ঢুকতে বলি, আরো অন্ধকার একটি গলি খুঁজি, সেই গলি পাই না; রিক্সাঅলাকে আবার চালাতে বলি। আমি শুধু তাকে চালাতে বলতে থাকি; কিন্তু কেউ সম্পূর্ণ গন্তব্যহীন হয়ে কিছু চালাতে পারে না; আমার রিক্সাঅলাও পারে না, সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু আমার ক্লান্তি নেই। আমি চোখ বুজে আমার গন্ত্যটিকে দেখতে পাই,–একটি মেয়ে আমাকে টেনে তার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলছে,–কিন্তু চোখ খুলে আর দেখতে পাই না।