মেয়েটি চমৎকার ছিলো, আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি, আমার আবার যেতে ইচ্ছে করছে।
দেলোয়ার কোনো কথা বলে না।
তুমি খুব পবিত্র, আমি বলি। ভেঙে পড়তে পড়তে আমি হাঁটতে থাকি।
দেলোয়ার একটি রিক্সা ঠিক করে, আমরা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকি। সে মোগলাই পারোটা আনতে বলে, দুটো করে মোগলাই পরোটা। আমি অর্ধেকও খেতে পারি না, দেলোয়ার তার দুটো শেষ করে; আমার থেকে একটি নিয়ে খেতে থাকে। আমি দেলোয়ারের মুখের দিকে বারবার তাকাই, তার মুখটিকে আমার পবিত্র মনে হয়; মনে মনে আমি আমার মুখ দেখার চেষ্টা করি। আমার মুখ দেখে আমার ঘেন্না লাগে; আমি দেখি আমার মুখটি বিকৃত হয়ে গেছে, চরিত্রহীনদের মুখ যেমন বিকৃত হয় আমার মুখ তেমন বিকৃত হয়ে গেছে। চরিত্রহীনদের মুখ কেমন? আমার মুখ যেমন? আমি আমার মুখ আর চরিত্রহীনদের মুখ দেখে দেখে ঘেন্নায় কুঁকড়ে উঠি। অনেক দিন পর আমার আত্মার কথা মনে পড়ে, মনে হয় আমার আত্মা অপবিত্র হয়ে গেছে।
দেলোয়ার বলে, তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলো।
আমি তার দিকে অপরাধীর মতো তাকাই।
আমি বলি, আমি অপরাধ করেছি।
দেলোয়ার বলে, তুমি ভার্জিন নও, বিয়ে করে তুমি সুখ পাবে না।
আমি বলি, আমার সুখী হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো।
দেলোয়ার হাসতে থাকে।
আমি বলি, আমি বিয়ে করবো না।
দেলোয়ার বলে, তুমি এতো খারাপ হবে আমি ভাবতে পারি নি।
নিজেকে আমার খুব খারাপ মনে হয়। আমার আর ভালোদের সাথে মেশা ঠিক হবে না। যে-মেয়েটিকে দেখে আমি কেঁপে উঠি, যাকে আমার খুব ভালো মনে হয়, তার দিকে আমি আর তাকাবো না। সে তার মামার সাথে বেবিতে যাক, তার দুলাভাইয়ের সাথে বেবিতে যাক, আমি আর কষ্ট পাবো না। দেলোয়ারের পাশে নিজেকে আমার অপবিত্র মনে হয়; আমি আর আমার পবিত্রতা ফিরে পাবো না বলে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয়। একটি জিনিশ আছে, কোথায় যেনো আমি পড়েছিলাম, হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি তা হারিয়ে ফেলেছি; আর ফিরে পাবো না।
দেলোয়ারকে দেখলেই, তারপর, আমার মনে অপরাধবোধ জেগে উঠতো। আমি তার দিকে এমনভাবে তাকাতাম যেনো আমি পবিত্র কিছু দেখছি। পবিত্র কোনো কিছু আমি বেশি দেখি নি; পবিত্র জায়গায় আমি কখনো যাই নি; দেলোয়ারই ছিলো আমার কাছে পবিত্রতা। আমি অনেক কিছু ছোঁয়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম;–ফুল, আমার কাছে পবিত্র মনে হতো; তাই আমি আর কোনো ফুল ছুঁই নি; আমার ভয় হতো ছুঁলেই পবিত্র ফুলটি অপবিত্র হয়ে যাবে। বই ছুঁতে আমার খুব কষ্ট হতো; কিন্তু বই আমার প্রিয়, বই ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে কষ্টকর; বই আমি না ছুঁয়ে পারি নি;–তবে বারবার বইয়ের কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছি। দেলোয়ারের যে-বোনটি, বিলকিস, যশোরে থাকে, যার দুটি তিনটি বাচ্চা, সে আমাকে একদিন খুব বিপদে ফেলে দিয়েছিলো; খুব অপরাধের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো, খুব বেদনার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। আমি যদি অপবিত্র না হতাম, তাহলে ওই বেদনা আমার হতো না; ওই অপরাধবোধ আমার হতো না। দেলোয়ারের খোঁজে এক বিকেলে আমি তাদের বাসায় যাই; গিয়ে দেখি কেউ নেই; শুধু বিলকিস রয়েছে। বিলকিস আমাকে দেখে চৈত্রের গোলাপের মতো ফুটে উঠতে আর ছড়িয়ে পড়তে থাকে; আর আমি অপরাধবোধে কাতর হয়ে পড়ি। বিলকিস দেখতে শ্যামলা, কিন্তু ওর মুখভরা সৌন্দর্য ও আমার মতো একটি অপবিত্র মানুষের জন্যে এমনভাবে ফুটছে দেখে আমার কষ্ট হয়।
বিলকিস আমাকে কিছুতেই ফিরে আসতে দেয় না; বাসায় আমাকে ঢুকতেই হয়, আমি বসার ঘরে বসি। বিলকিস চমৎকার চা বানাতে পারতো; তার বানানো চা খেয়েই সারাজীবন বেঁচে থাকা সম্ভব বলে কখনো কখনো আমার মনে হতো। বিলকিস আমার জন্যে চা বানিয়ে আনে, সোনালি চা দেখে আমার ভয় লাগতে থাকে; যদি ওই চা আমার ছোঁয়ায় নোংরা হয়ে যায়?
বিলকিস বলে, আনিসভাই, চা খান।
আমি বলি, এই খাচ্ছি।
বিলকিস বেরিয়ে যায়, আমি এক চুমুকে চা শেষ করে ফেলি; বারবার পেয়ালা ছুঁতে আমার সাহস হয় না। দেখি বিলকিস একটি লাল টকটকে গোলাপ হাতে ঢুকছে, দেখে আমি আবার ভয় পাই। বিলকিস আমার দিকে গোলাপটি বাড়িয়ে আমার মুখের দিকে গোলাপের মতো ফুটে থাকে। শ্যামলা গোলাপের মতো বিলকিসের মুখ, তার হাতে লালগোলাপ;–আমি আমার সামনে দুটি গোলাপ দেখতে পাই, দুটি গোলাপের কাছে অপরাধী বোধ করি।
বিলকিস অদ্ভুতভাবে ফুটতে ফুটতে বলে, নিন।
আমি বলি, না, বিলকিস।
বিলকিস বলে, কেনো?
আমি বলি, আমি ছুঁলে গোলাপটি অপবিত্র হয়ে যাবে।
বিলকিস আমার দিকে বিস্মিত হয়ে থাকায়।
আবার বলে, কেনো?
আমি বলি, আমি অপবিত্র।
বিলকিস বলে, তাতে কিছু যায় আসে না আনিস ভাই।
আমি আবার বলি, বিলকিস, আমি অপবিত্র।
বিলকিস কেঁদে ফেলে, তাতে কিছু যায় আসে না আনিস ভাই, আমার কাছে আপনি পবিত্র।
বিলকিস নিশ্চয়ই সত্য বলছে, আমার এমন বিশ্বাস হতে চায়; তবু আমি বিলকিসের হাত থেকে গোলাপ নিতে পারি না; আমার ভয় হতে থাকে আমি ছুঁলেই গোলাপের পাপড়ি থেকে পুঁজ ঝরতে থাকবে।
আমি বলি, বিলকিস, আমি ছুঁলে গোলাপটি পুঁজে ভরে উঠবে, পাপড়ি থেকে পুঁজ ঝরতে থাকবে।
বিলকিস কাঁপতে থাকে।
বিলকিস গোলাপটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার পাশে বসে; তার শ্যামল মুখটি আমার মুখের কাছে তুলে ধরে, এবং বলে, তাহলে একবার আমাকে ছূঁন, আনিস ভাই; একবার আমাকে ছূঁন।