দেলোয়ারের কথা শুনে মানসম্মানের কথা আমার মনে পড়ে। মানসম্মানের কথা কি আমি কখনো ভাবি নি? সব সময়ই তো আমি মানসম্মানের কথা ভেবেছি, কিন্তু আজ আমার মনে পড়লো না কেনো? সত্যিই, যে-মেয়েটিকে দেখলে আমি কেঁপে উঠি,–কেনো যে কাঁপি আমি জানি না; যে-মেয়েটির সাথে তার দুলাভাই আর মামা মাঝেমাঝেই দেখা করতে আসে–আমি বুঝতে পারি না দুলাভাই আর মামারা কেনো এতো স্নেহ পোষণ করেন; মামার সাথে আর দুলাভাইয়ের সাথে মাঝেমাঝেই যে বেবিতে চেপে কোথায় চলে যায়–মামা আর দুলাভাইয়ের সাথে তার কেনো কোথায় যেতে হয়?–সে যদি জেনে ফেলে আমি ব্রোথেলে গিয়েছিলাম, তাহলে আমার মানসম্মান থাকবে না। ওই মেয়েটিকেই মনে পড়ে আমার; কেনো যে মানসম্মানের প্রসঙ্গে শুধু মেয়েটিকেই মনে পড়ে আমি বুঝতে পারি না।
দেলোয়ার বলে, সব কিছু গোপন করতে জানতে হয়।
আমি বলি, হ্যাঁ।
দেলোয়ার বলে, যারা গোপন করতে পারে তারাই সৎ মানুষ–চরিত্রবান।
আমি বলি, আমি মাঝেমাঝে কিছু কিছু গোপন করি।
দেলোয়ার জানতে চায়, যেমন?
আমি বলি, আমি একবার বাবার পকেট থেকে দশ টাকা চুরি করেছিলাম।
দেলোয়ার জানতে চায়, তারপর?
বাড়িতে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিলো, আমি বলি, তবে সবাই আমাকে ভালো জানতো, তাই আমাকে কেউ সন্দেহ করে নি; কিন্তু বাড়ির সবাইকে সন্দেহ করা হয়েছিলো।
দেলোয়ার বলে, তুমি কি সত্যটি এই প্রথম প্রকাশ করলে?
আমি বলি, হ্যাঁ।
দেলোয়ার বলে, সৎ মানুষ হিশেবে তুমি একদিন প্রসিদ্ধ হবে।
আমি বলি, কিন্তু চেপে রাখতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। তোমাকে বলতে পেরে কষ্টটা কমলো।
দেলোয়ার বলে, সৎ মানুষদের অনেক কষ্ট, অনেক সত্য তাদের চেপে রাখতে হয়।
সৎ মানুষদের কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার আর সৎ মানুষ হতে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে ব্রোথেল থেকে ফিরেই সবাইকে জানিয়ে দেবো আমি ব্রোথেলে গিয়েছিলাম। তারপরই আমার ভয় হয়; দেখতে পাই জানিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই আমি আর কোথাও নেই। চারপাশে সৎ মানুষেরা ভিড় করে আসছে; তারা আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলছে, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান অসৎ, চরিত্রহীন; সে এখানে থাকতে পারে না। কিন্তু আমাকে এখানে থাকতে হবে।
দেলোয়ার একটি বেবি ঠিক করে; আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠি। এখানে যে ট্যাক্সি পাওয়া যায়, আসার সাথে সাথেই যে ড্রাইভাররা টানাটানি করে ট্যাক্সিতে তোলে, আমার জানা ছিলো না। আমার চমৎকার লাগতে থাকে, এবং ভয় করতে থাকে। নারায়ণগঞ্জে গিয়ে নামার সাথে সাথে দেলোয়ার একটি রিক্সা নেয়। দেলোয়ার যে রিক্সাটিকে কোথায় যেতে বলে আমি বুঝতে পারি না; আমার ভয় লাগতে থাকে এবং আমার চমৎকার লাগতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আমদের রিক্সা একটি অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে; এবং আরো একটি অন্ধকার গলির মুখে এসে থামে। আমি দেলোয়ারের পাশে পাশে হেঁটে গলিতে ঢুকি, তার পেছনে হাঁটতে চাই না; পেছনে হাঁটতে আমার ভালো লাগে না। পেছনে হাঁটলে দেলোয়ার আমাকে কাপুরুষ মনে করতে পারে, বলতে পারে আমি ব্রোথেলে আসার উপযুক্ত হই নি; কিন্তু আমি সম্পূর্ণ উপযুক্ত। হেঁটে যেতে যেতে একটি মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না। এই প্রথম কোনো মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে; তার মুখটি আমার ভালো লাগে।
তুমি ওর ঘরে ঢোকো, দেলোয়ার বলে, আমি সামনে যাই।
আচ্ছা। আমি বলি।
মেয়েটি আমাকে টেনে তার ঘরে ঢুকোয়।
আমার বেশ ভালোই লাগছিলো, যদিও মেয়েটি আমার পকেটে হাত দিয়ে আরো পাঁচটি টাকা নিয়ে নিয়েছিলো; এবং কিছুতেই ব্লাউজ খোলে নি, যদিও আমি বারবার খুলতে বলছিলাম; যদিও মেয়েটি আমাকে তাড়াতাড়ি করতে বলছিলো, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ির উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারছিলাম না; এবং যদিও আমি ভালোভাবে পারি নি, আমি বাইরে পড়ে গিয়েছিলাম; তবু ভালো লাগার অনুভূতিটি আমার অনেকক্ষণ ছিলো। আমি একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি বলে সুখ লাগছিলো; আমার শরীর থেকে বিরক্তি অনেকটা কেটে গিয়েছিলো। কথা ছিলো গলির মোড়ের দোকানটির সামনে আমরা আবার মিলিত হবো। আমি গলির মোড়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে সিগারেট টানতে থাকি, একটি পুলিশ এসে টাকা চাইলে তাকে আমি পাঁচটি টাকা দিই, কিন্তু সে দশ টাকা চায়; আমি বেশ ভয় পাই, এবং তিন চারটি সিগারেট টেনে শেষ করে ফেলি; এক সময় দেলোয়ারকে আসতে দেখে খুশি হয়ে উঠি।
হাঁটতে হাঁটতে দেলোয়ার আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কেমন লাগলো?
আমি বলি, খুব ভালো।
দেলোয়ার বলে, তুমি করেছো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার কেমন লাগলো?
দেলোয়ার বলে, আমি তো করি নি।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।
দেলোয়ার বলে, আমি দেখতে এসেছিলাম, করতে আসি নি।
আমি চুপ করে থাকি।
দেলোয়ার বলে, তুমি আর ভার্জিন নও, তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলো।
আমি ভেঙে প’ড়ে যেতে চাই।
আমি একবার দেলোয়ারকে জিজ্ঞেস করি, তুমি সত্যিই করো নি?
দেলোয়ার বলে, আমি তোমার মতো না।
পা ফেলতে আমার কষ্ট হতে থাকে; আমার মনে হতে থাকে দেলোয়ার সৎ, তার চরিত্র ভালো, সে ব্রোথেলে এলেও এখানকার মেয়েগুলোর সাথে কিছু করে না, তার কৌমার্য নষ্ট হয় নি; আমি সৎ মানুষ নই, আমার চরিত্র ভালো নয়, আমি একটি পতিতা মেয়ের সাথে করেছি; আমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে; আমি আর আমার চরিত্র ফিরে পাবো না; আমি আর আমার কৌমার্য ফিরে পাবো না। কৌমার্য হচ্ছে পবিত্রতা, আমি কোথায় যেনো পড়েছিলাম; আমি আর পবিত্র নই। নিজেকে আমার ঘেন্না লাগতে থাকে; বমি বমি লাগতে থাকে; চারপাশের দিকে আমি তাকাতে পারি না; মনে হতে থাকে সবাই বুঝতে পারছে আমি চরিত্রহীন; আমি ব্রোথেলে এসেছি, একটি পতিতা মেয়ের সাথে করেছি। ইচ্ছে হয় হলে ফিরে ব্লেড দিয়ে আমার অঙ্গটিকে কেটে ফেলতে। তাহলে আমি আবার পবিত্র হয়ে উঠতে পারবো। বসে পড়ে আমার গলগল করে বমি করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি বসি না; বরং উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি।