ডুবুরিরা দেলোয়ারের গাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না; স্রোতের টানে গাড়ি আর দেলোয়ার তাদের সমস্ত সীমার বাইরে চলে গেছে; আর পাওয়া যাবে না। শুনে আমার অদ্ভুত ধরনের ভালো লাগে। কিন্তু কেনো? দেলোয়ারের লাশ আমার দেখতে হবে না বলে? দেলোয়ারের লাশের কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে না বলে? দেলোয়ারের লাশ যদি আমার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, আনিস, তুমি গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো, আমি কী জবাব দেবো? আমি কি তাকে বলতে পারবো মাংসমেশানো গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো? আমার ভালো লাগছে তার লাশ আর পাওয়া যাবে না। আমি যেনো তার লাশ গুম করে ফেলতে চাই; যেনো আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে খুন করেছি, লাশটি গুম করে ফেলতে পারলে আমি বেঁচে যাই, এমন মনে হতে থাকে; আমি প্রার্থনা করতে থাকি যেনো কোনো ডুবুরি কোনো দিন দেলোয়ারের লাশ খুঁজে না পায়। পরমুহূর্তে মনে হয় আমি কখনো প্রার্থনা করি নি; প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই; প্রার্থনা আমার কাছে হাস্যকর। আমার করুণা হয় নিজের জন্যে। অমনি আমি দেখতে পাই শুয়ে শুয়ে আমি পুরোনো প্লেবয় পড়ছি, চা খাচ্ছি, সিগারেট টানছি; আমি কোনো নদীতে নেই, গাড়িতে নেই, মাংসমেশানো সুগন্ধে নেই।
দেলোয়ার এখন একটি শূন্য, আমার মনে হতে থাকে, দেলোয়ার কখনো ছিলো না। মরে গেলে সবাই শূন্যে পরিণত হয়। যে মরে যায়, তার কাছে সে শূন্য হয়ে যায়; সে জানে না, সে ছিলো; অন্যরাই শুধু জানে সে ছিলো। আমি জানি দেলোয়ার ছিলো; দেলোয়ার জানে না সে ছিলো। ডলি জানে দেলোয়ার ছিলো; কিন্তু আজ আর দেলোয়ার জানে না ডলি ছিলো, আর সে ছিলো, আর সুগন্ধ ছিলো, আর মাংস ছিলো। শূন্য হয়ে যাওয়া খুব কষ্টের ব্যাপার; তবে যে শূন্য হয়ে যায় তার কোনো কষ্ট থাকে না। কষ্ট অন্যদের। আমি কষ্ট পাচ্ছি, দেলোয়ারের জন্যে কষ্ট পাচ্ছি; এবং আমার ভেতর থেকে একটি ঘটনা জেগে উঠছে। ঘটনাটি জেগে উঠতেই আরো কষ্ট পাই, আমার শরীর ভেঙে আসে; আমি অন্ধকার দেখতে পাই। আমার সামনে নদী, অত্যন্ত সুন্দর নদী, যাতে আমার বারবার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি লাফিয়ে পড়ছি না, যাতে দেলোয়ার ডুবে গেছে, আর উঠে আসবে না, ওই নদীই আমার ভেতরে ঘটনাটি জাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নদীর সাথে ঘটনাটির কোনো সম্পর্ক নেই। নদী ঘটনাটি জানে না; এখন আমি ছাড়া আর কেউ জানে না; দেলোয়ার যেহেতু এখন শূন্য, তাই সেও জানে না। ঘটনাটি আমার ভেতর জেগে উঠছে; অনেক দিন ভেতরে তলিয়ে ছিলো, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায় নি, জেগে উঠেছে মাঝেমাঝেই; এবং এখন চর হয়ে দেখা দিচ্ছে। সলিমুল্লাহ হল, সন্ধ্যা, অন্ধকার জেগে উঠছে আমার ভেতরে। আমরা দুজনই তখন কষ্টে ছিলাম-সুন্দর মধুর বিষাক্ত কষ্টের সময় ছিলো সেটা আমাদের। নদী কেনো আমার ভেতরে ওই সন্ধ্যা জাগিয়ে তুলছে? দেলোয়ার শূন্য হয়ে গেছে, সে আর কখনো আমার জীবনে এতোটা জীবিত থাকবে না, তার সাথে আজই আমার শেষ সম্পর্ক, তাই কি ঘটনাটি শেষবারের মতো জেগে উঠছে আমার ভেতরে? সন্ধ্যার অন্ধকারে দেলোয়ার আর আমি সলিমুল্লাহ হলের গাছের অন্ধকারে হাঁটছি, দেলোয়ার একটি প্রস্তাব দিচ্ছে;–আমার মনে হচ্ছে দেলোয়ার এখনই আমাকে প্রস্তাব দিচ্ছে, আর আমি তাতে সাড়া দিচ্ছি।
চল্, দেলোয়ার বলে; তারপর ক্রিয়াটি সংশোধন করে বলে, চলো, এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
তার ‘চল’ আর ‘চলো’ শুনে আমি একটু বিব্রত হই, যেনো আমি কোনো অপরাধ করেছি, এমন মনে হয়। এটা ঘটে আসছে অনেক বছর ধরেই। দেলোয়ার আমাকে মাঝেমাঝেই ‘তুই’ বলে ফেলে, বন্ধুদের ‘তুই’ বলাই দেলোয়ারের অভ্যাস; তার অন্য বন্ধুরাও তাকে ‘তুই’ বলে; কিন্তু আমি তাকে কখনো তুই বলি নি; তাই আমাকে ‘তুই’ বলতে গিয়ে সে আজো থেমে যায়, অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলে ‘তুমি’। তার সাথে দেখা হলেই কথা শুরু করতে গিয়ে আমি অপরাধবোধে ভুগি; আমার মনে হয় দেলোয়ার মনে মনে ‘তুই’ বলতে চাচ্ছে, এবং চাচ্ছে আমিও তাকে ‘তুই’ বলি; কিন্তু আমি যেহেতু ‘তুমি’ বলবো, তাই সে তার কথার জগতটিকে আমার জন্যে পাল্টে নিচ্ছে। আমি দেলোয়ারকে তুই বলতে পারি নি, কাউকেই পারি নি, এতে সব সময়ই আমার মনে হয়েছে আমি অপরাধ করছি।
কোথায়? আমি জানতে চাই।
নারায়ণগঞ্জে।
কেনো?
তুমি কিছু না মনে করলে বলতে পারি।
বলো, কিছু মনে করবো না।
দেলোয়ার ব্রোথেলে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়; আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। এতে তাড়াতাড়ি রাজি হই যে আমার মনে হয় দেলোয়ার প্রস্তাব না দিলে আমিই প্রস্তাবটি দিতাম। অনেক বছর ধরে রক্তে একটি বিরক্তিকর ক্ষুধা চেপে রেখে রেখে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; আমি আর ক্লান্তির মধ্যে থাকতে চাই না; মনে হয় দেলোয়ার আমাকে উদ্ধার করছে। আমার ভয় হতে থাকে দেলোয়ার যদি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আমাকে একলাই নারায়ণগঞ্জে যেতে হবে। কিন্তু আমি চিনি না। আমি আর বিরক্তি সহ্য করতে পারছি না।
নারায়ণগঞ্জ কেনো, ঢাকায়ই তো আছে? তবু আমি জানতে চাই।
ঢাকার থেকে নারায়ণগঞ্জই ভালো, দেলোয়ার বলে, ঢাকায় আমাদের কেউ দেখে ফেলতে পারে।
দেখে ফেললে কী হবে? আমি বলি।
মানসম্মান থাকবে না। দেলোয়ার বলে।