আমি বলি, আমাকে ধরতে তোমার ইচ্ছে করে না?
রোকেয়া বলে, করে।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরি, ও আমাকে ধরে; কিন্তু এখনো ধরতে শেখে নি, ওর হাত দুটি আমার শরীরে ঝুলে থাকে। আমার চুমো খেতে ইচ্ছে করে, আমি ওকে চুমো খাই; ওর মাংসল ঠোঁট দুটি ঠোঁটের ভেতরে পুরে রাখি, ও ঝুলে পড়ে যেতে চায়, আমার দু-হাতে ঝুলতে থাকে; অন্ধকার আর অস্পষ্ট আলো দিকে দিকে কাঁপতে থাকে।
আমি বলি, তুমি কি সব কিছু গোপন রাখতে পারো?
রোকেয়া বলে, পারি।
বাইরে, আকাশে, গাছের পাতায়, ফুলের পাপড়িতে, ঘাসের শিখায়, শিশিরে, পাখির পালকে ভোর হয়।
আমি কি অপরাধ করেছি? আমি কি সুখী বোধ করি নি? সুখী বোধ করা অপরাধ? এ-বয়সে সুখী বোধ করা ঠিক নয়, এটা পীড়িত হওয়ার সময়, এখন যতোই পীড়িত বোধ করবো ততোই নিজেকে সৎ মনে করবো; কিন্তু আমি পীড়িত বোধ করছি না, অপরাধ বোধ করছি না। সুখে ভেসে যাচ্ছি বা আনন্দে কাঁপছি বা আবেগে অধীর হয়ে উঠছি, তাও নয়; অদ্ভুত ভারী শান্ত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। অফিসে গিয়ে সারা অফিসটার দিকে তাকিয়ে আমার নিঃশব্দে হাসি পায়, কী হাস্যকর চারপাশ। অফিসটায় আমার থাকতে ইচ্ছে করে না, কোনো অফিসেই নয়। অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় রোকেয়াকে দেখি, ওর মুখেও কোনো অপরাধ দেখতে পাই না; ওকে নির্মল দেখাচ্ছে, প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। হয়তো ওকে আগেও এমনই দেখাতো, আমি খেয়াল করি নি, তাই আজ ওকে আমার এমন নির্মল আর প্রফুল্ল মনে হচ্ছে। দোতলায় ওঠার সময় দেখি ও সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে খাবার দিতে বলি।
দীন মুহম্মদ দাঁড়িয়ে আছে, রোকেয়া খাবার দিচ্ছে, আমি খাচ্ছি।
রোকেয়া বলে, স্যার, আজ আমি চশমা নিতে যাবো।
দীন মুহাম্মদ বলে, অনেকগুলিন ট্যাকা লাইগ্যা যাইব, স্যার।
আমি বলি, টাকাটা তুমি আমার থেকে নিয়ে যেয়ো।
দীন মুহাম্মদ বলে, আপনে না হইলে অর চোকটা নষ্ট অইয়া যাইত, স্যার।
আমি বলি, ওর জন্যে কিছু জামাকাপড়ও কেনো, আমার থেকে টাকাটা নিয়ো।
আগামীকাল ভোরে, মেয়েটি, রোকেয়া, চলে যাবে। আমি কি ওর অভাব বোধ করবো? না। আমি কারো অভাব বোধ করি না; ডলির অভাব বোধ করি না, ওর অভাবও বোধ করবো না। আমি কি চাই ও চলে যাক? হ্যাঁ, আমি চাই, ও চলে যাক। কিন্তু কেনো? আমি জানি না। আজ ভোর থেকেই ও আমার ঘরে আসছে, হাসছে, কথা বলছে, এমন কি আমি যেনো অফিসে না যাই এমন এক অনুরোধও করে আমাকে। বিস্মিত করে দিয়েছে; আমি অফিসে গেছি, প্রচণ্ড কাজ করেছি, পাঁচটি বৈঠক করেছি, ওর কথা আমার মনে পড়ে নি। মনে পড়ে নি? সত্যিই মনে পড়ে নি? না পড়াই ভালো। আমি কি আজ একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছি? হয়তো। কিন্তু তা ঘটেছে বৈঠকগুলোকে আমি বেশি সময় নষ্ট করতে দিই নি বলে; আর কয়েকবার কফি খেলে, পরস্পরকে আরেকটুকু বেশি প্রশংসা করলেই বাসায় ফিরতে বিকেল করে দিতে পারতাম। তা আমি করি নি। কেনো করি নি? এভাবেই, কোনো কারণ নেই; বিকেল করে দিতে আমার ইচ্ছে করে নি। আমি তাড়াতাড়ি ফেরায় মেয়েটি, রোকেয়া, কেনো এতো খুশি হলো? ও দৌড়ে নিচে নেমে এসেছে। ওর দৌড়ে নেমে আসাটা আমার ভালো লেগেছে, ভরাট হাসিটি আমার ভালো লেগেছে; আমি বাসায় ঢোকার সময় ও আমার একটু পেছনে পেছনে বাসায় ঢুকেছে, আমার ঘরে ঢুকেছে। আমি খেয়েই বেরিয়ে পড়েছি, আমার আরো কয়েকটি বৈঠক আছে; বেরোনোর সময় ও খুব অবাক আর বিষণ্ণ হয়েছে। বৈঠক করে সন্ধ্যার বেশ পরে আমি বাসায় ফিরি।
দীন মুহাম্মদ আমাকে খেতে দেয়, আমি খাই। রোকেয়াকে দেখতে পাই না।
দীন মুহাম্মদ বলে, স্যার, কাউলকা সকালেই যামু, দুই দিনের মধ্যেই ফির্যা আসুম।
আমি বলি, দেরি কোরো না, আমার অসুবিধা হবে।
দীন মুহাম্মদ বলে, না, স্যার, দেরি অইব না।
একটু পরেই বারোটা বাজবে, বোতল থেকে চুমুক দিয়ে আমি একটু একটু পান করি, আর একটি বই পড়ি, এবং পড়তে পারি না; এমন সময় দরোজা ঠেলে রোকেয়া ঢোকে। আজ ও বিছানায় আমার পায়ের কাছে বসে না, আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ও কি এতোক্ষণ ধরে কাঁদছিলো? এজন্যেই ওকে সুন্দর লাগছে?
রোকেয়া বলে, স্যার, আজ সারাদিন আপনি বাইরে রইলেন কেনো?
আমি বলি, খাবার সময় থেকে তো বাসায়ই আছি। তোমাকে দেখলাম না।
রোকেয়া বলে, ইচ্ছে করছিলো আপনাকে না দেখেই কালকে চলে যাবো; আপনাকে আর দেখবো না।
এমন সময় ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে টেলিফোন বেজে ওঠে।
ডলি বলে, তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো ঠিক করেছি।
আমি বলি, তুমি ছেড়ে দিতে চাইলে আমি আর কী করতে পারি?
ডলি বলে, শিগগিরই তুমি কাগজপত্র পাবে।
আমি বলি, কাগজপত্রের কী দরকার?
আমি টেলিফোন রেখে দিই।
রোকেয়া বলে, আপনি একলা হয়ে যাবেন।
আমি বলি, না। আবার টেলিফোন বাজতে থাকে, আমি ধরি না।
রোকেয়ার একটি হাত কি আমি এততক্ষণ ধরে ছিলাম? আমি ওকে কাছে টানি, ও বিছানায় উঠে আসে। আমি ওকে খুলি; ও গভীর ঘুমের মতো জেগে থাকে, ওর মাংস কদম হতে থাকে, এবং একবার কেঁপে ডুকরে ওঠে।
ভোরে ঝলমল ক’রে ও আসে। ওর হাতে আমি একটি বড়ো প্যাকেট দিই।
ও জিজ্ঞেস করে, এটায় কী আছে, স্যার?
আমি বলি, এখন দেখবে না, গিয়েই ব্যাংকে জমা দেবে।
রোকেয়া প্যাকেটটি বুকে চেপে ধরে।
সময় হয়ে গেছে; সালাম করে দীন মুহাম্মদের সাথে ও বেরিয়ে যায়; গেইটের কাছে গিয়ে একবার ফিরে তাকায়; আমি ওকে দেখি, ও হয়তো কিছু দেখতে পায় না। একটু পর আমি অফিসে যাই। অফিসে গিয়ে এক পেয়ালা কফি খাই, কফিটা খেতে আমার অনেক সময় লাগে, সময় লাগাতে আমার ভালো লাগে; কাউকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করে দিই, কোনো টেলিফোন ধরি না। আমি পদত্যাগ পত্র লিখি, মাত্র একটি বাক্য; সহকারীর হাতে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। বাইরে এসে রিকশা নিই; রিকশাঅলা জানতে চায় কোথায় যাবো, আমি শুধু বলি, চালাও। আমার ইচ্ছে করে শহর ছেড়ে যেতে, এখনই ছেড়ে যেতে, আর না ফিরতে। শহরকে আমার অচেনা মনে হয়, চিনতে ইচ্ছে করে না। রিকশাঅলাকে আমি শহরের বাইরে যেতে বলি; সে একটি খেতের পাশে এসে জানতে চায় আমি নামবো কি না। আমার ভালো লাগে, আমার নামতে ইচ্ছে করে; আমি নামি, হাঁটতে থাকি; হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে যেতে ইচ্ছে করে, অনেক দূরে; আমি হাঁটতে থাকি; আমি হাঁটি, আমি হাঁটতে থাকি, শহর ছেড়ে অনেক দূরে যেতে থাকি, আমি হাঁটতে থাকি।