মেয়েটি বলে, না, না; আমি আর কিছু জানতে চাই না।
আমি বিছানার নিচে থেকে বোতলটি বের করে একবার চুমুক দিই, ছিপি লাগিয়ে বোতলটি রাখি, মেয়েটি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, তোমার কি আরো বই লাগবে?
মেয়েটি বলে, জি, স্যার।
আমি বলি, ওই ঘরে গিয়ে তুমি যেগুলো ইচ্ছে নিয়ে নাও।
মেয়েটি বলে, আরেকটু বসি, স্যার?
আমি বলি, কেনো বসতে চাও?
মেয়েটি বলে, বসতে ইচ্ছে করছে।
আমিই উঠি; শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগছে, শুয়ে থাকতে আমার খারাপ লাগছে। মেয়েটিকে আমি পড়ার ঘরে নিয়ে যাই, আলমারি থেকে বই নামিয়ে দিতে থাকি, মেয়েটি দু-হাতে বই জড়িয়ে ধরতে থাকে।
আমি বেরিয়ে যাই, বেশ রাত করেই ফিরি, অনেক কাজ ছিলো। ফেরার সাথে সাথে দীন মুহাম্মদ এসে জানতে চায় খেতে দেবে কি না। আমি তাকে খাবার দিতে বলি। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি রোকেয়া টেবিল সাজাচ্ছে; ওর টেবিল সাজানো দেখে আমার ভালো লাগে।
মেয়েটি বলে, স্যার, আজ আমি বেঁধেছি, কেমন যে হয়েছে জানি না।
দীন মুহাম্মদ বলে, আমি অরে রানতে দিতে চাই নাই, স্যার, ওই জোর কইর্যা রানলো। ভাল না অইলে মাপ কইরা দিয়েন।
খাওয়ার ব্যাপারটি কখনোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; খুব স্বাদ হলে আরো খাওয়ার জন্যে পাগল হই না, স্বাদ না হলে ছুঁড়ে ফেলি না; কেউ যত্ন করে খাওয়ালে তৃপ্তিতে ভরে উঠি না; কেউ পাতে খাবার দিতে থাকলে উচ্ছ্বসিত হই না। আমার কাছে খাওয়া হচ্ছে খাওয়া, তার বেশি নয়। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটি ভয়ে আছে, হয়তো আমি বলবো রান্না ভালো হয় নি; আবার একটু প্রত্যাশায়ও রয়েছে, হয়তো আমি বলবো চমৎকার হয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই বলি না। ভয় আর প্রত্যাশার মধ্যে থেকে থেকে মেয়েটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
কিছু একটা আমার বলা উচিত; মেয়েটি বেশ ক্লান্তিতে রয়েছে।
আমি বলি, রোকেয়া, তুমি কতোটা রাত জেগে থাকো?
রোকেয়া বলে, একটা-দুটো হবে, স্যার।
আমি বুলি, এতো রাত জেগে কী করো?
রোকেয়া বলে, পড়ি, আর মাঝেমাঝে ভাবি, স্যার।
আমি বলি, কী ভাবো?
রোকেয়া বলে, মাধ্যমিক পাশ করার পর আমার কী হবে, সেকথা ভাবি, স্যার। আমার তো ভবিষ্যৎ নেই।
আমি চমকে উঠি।
রোকেয়া বলে, আপনি কখন ঘুমোন, স্যার।
আমি বলি, বারোটা-একটা হবে।
বেশ রাত হয়েছে, আমি ঘুমোই নি; দু-তিনটি বই একসাথে পড়ছি, একটি সিনেমা পত্রিকাও অনেকক্ষণ ধরে উল্টোচ্ছি, মাঝেমাঝে ছিপি খুলে বোতল থেকে একটু একটু পান করছি, ডলির টেলিফোনের কথা বারবার আমার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, আমার হাসি পাচ্ছে, খুব দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে, অ্যাসট্রেতে একটি সিগারেট রেখে আরেকটি সিগারেট একবার জ্বালিয়ে ফেলেছি, এমন সময় দরোজায় একটু শব্দ হয়।
আমি জিজ্ঞেস করি, কে?
মেয়েটি বলে, আমি, স্যার।
আপনি জেগে আছেন?
আমি বলি, ভেতরে আসবে?
মেয়েটি বলে, জি, স্যার।
রোকেয়া ভেতরে ঢুকে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে, আমি ওকে বসতে বলি না; ও যেনো আগে থেকেই জানে কোথায় ওর বসার স্থান, কোথায় ও বসবে। ও বিছানায় আমার পায়ের কাছে এসে বসে। ওর বসার ভঙ্গিটি ভাস্কর্যের মতো; আমার ভালো লাগে। এখন কতো রাত? দুটো? তিনটে? মেয়েটিকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে; আমি ওর দিকে সরাসরি তাকাই, আমি দেখি।
আমি বলি, তোমার ঘুম আসছে না?
মেয়েটি বলে, ইচ্ছে করেই ঘুমোচ্ছি না, স্যার। জেগে থাকতে ইচ্ছে করছে।
আমি বলি, এখানে কেনো এলে?
মেয়েটি বলে, ইচ্ছে করলো, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করলো।
আমি বলি, কেনো ইচ্ছে করলো?
মেয়েটি বলে, তা আমি বুঝতে পারছি না।
মেয়েটি কথা বলার সময় হাসে, হাসতে হাসতে কথা বলে, এই ওর অভ্যাস; ওর প্রতিটি কথায় হাসির একটা ঝংকার লেগে থাকে। আমার ভালো লাগে।
আমি বলি, আমার সাথে সারারাত জেগে থাকতে পারবে?
ও ঝলমলিয়ে ওঠে, পারবো, স্যার। এক রাত কেনো, দু-তিন রাতও জেগে থাকতে পারবো।
আমি বলি, একরাত পারবে তো?
মেয়েটি বলে, আপনি কি সত্যিই সারারাত জেগে থাকবেন?
আমরা সারারাত জেগে থাকি। এর আগে আমি কখনো সারারাত জেগেছি? জেগে থাকতে ইচ্ছে করেছে? আমার মনে পড়ে না। ডলিকে নিয়ে কখনো সারারাত জেগেছি? আমার মনে পড়ে না। এ-মেয়েটি যদি ডলি হতো, সারারাত জেগে থাকতে পারতাম? জেগে থাকতে ইচ্ছে করতো? না, ইচ্ছে করতো না। রোকেয়াকে আমি একটি বই পড়তে বলি, ও পড়তে থাকে; অনেকখানি পড়া হয়ে গেলে আরেকটি বই পড়তে বলি, ও পড়তে থাকে, আমি শুনতে থাকি, এবং আমি ওকে দেখি। দেখতে আমার ভালো লাগে। আমি যে ওকে দেখছি, ও বুঝতে পারছে; ওর ভালো লাগছে। ওর ঠোঁট দুটি বেশ মাংসল, ওর পড়ার সময় মাংসের আশ্চর্য সঞ্চালন চোখে পড়ে। ওর মুখটিও পরিপূর্ণ, কোথাও শুষ্কতা নেই, সবটাই সজল। আমি ওকে দেখি। আমার কি ওকে দেখা ঠিক হচ্ছে? একবার পড়া বন্ধ করে ও আমার কাছে গল্প শুনতে চায়। ওকে আমি কোন গল্পটি শোনাতে পারি? আমি ঠিক করতে পারি না। শেষে একটি গল্প বলি, এক পুত্র খুন করে পিতাকে; সে খুন করতে চায় নি, তবু খুন করে, আর বিয়ে করে মাকে, রাজা হয়, এগিয়ে যায় নিজের নিয়তির দিকে, এক দিন উপড়ে ফেলে নিজের চোখ। শুনে ও শিউরে ওঠে, আমি দেখতে পাই ও বয়স্ক হয়ে উঠছে। আমি রাতের শব্দ শুনতে পাই; আমার বারান্দায় যেতে ইচ্ছে করে, আমরা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। অন্ধকার ও আলোর মধ্যে চারপাশের বাড়িগুলো, গাছগুলো কখনো দেখি নি; এ-রাতে দেখতে পেয়ে আমি সুখ পাই। রোকেয়ার কাঁধের ওপর হাত রেখে আমার অন্ধকার দেখতে ইচ্ছে করে, আমি রোকেয়ার কাঁধে হাত রাখি; রোকেয়া আমার দিকে তাকিয়ে একবার মুখ নিচু করে, আবার আমার দিকে তাকায়।