আমি বলি, তুমি কি তোমার বাবার ঘরে থাকতে পারবে?
রোকেয়া বলে, জি, পারবো।
আমি বলি, পশ্চিম দিকের ঘরটি তো খালি পড়ে আছে, ইচ্ছে করলে তুমি থাকতে পারো।
দীন মুহাম্মদ খুশি হয়ে ওঠে; রোকেয়ার মুখেও ঝিলিক দেখা দেয়।
দু-তিন দিন বা তার বেশি হবে আমি মেয়েটিকে দেখি নি; একটি মেয়ে যে পাশেই একটি ঘরে আছে, তাও টের পাই নি। সেদিন বিকেলে বাসায় গাড়ি ঢুকতেই দেখি রোকেয়া ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছে, হয়তো চোখটিকে পরীক্ষা করছে; ঘাস আর ফুলের বাগানে ওকে বেশ মানিয়েছে; আমি নামতেই সালাম দেয়। এই প্রথম ওকে আমি হাসতে দেখি। ওর হাসিটি আমার ভালো লাগে, অনেক দিন কোনো হাসি এতোটা ভালো লাগে নি; আরো দেখতে ইচ্ছে করে; কিন্তু আমি কি ওকে আমার সাথে ওপরে উঠতে বলতে পারি? ও কি রাজি হবে? আমার সাথে ওপরে উঠতে কি ওর ভালো লাগবে? দীন মুহাম্মদকে আমি যে-কোনো আদেশ দিতে পারি, ওকে পারি না; ও দীন মুহাম্মদ নয়। আমার ইচ্ছে করে আমার সাথে ও ওপরে আসুক। আমি ওকে আমার সাথে আসতে বলি, বলার আগে একটু দ্বিধা হচ্ছিলো, কিন্তু বলার সময় আমার কোনো দ্বিধা থাকে না। ভেবেছিলাম ও আসবে না; লজ্জা পাবে, বা ভয়, কিন্তু ও আমার সাথে হাঁটতে থাকে, এমনভাবে হাঁটে যেনো খুব সুখ পেয়েছে, এমন সুখ ও চেয়েছিলো মনে মনে, না পেলে খুব দুঃখ পেতো। ও সিঁড়ি দিয়ে আমার সাথে দোতলায় ওঠে, আমার সাথে ঘরে ঢোকে। আমি সোফায় বসি, ওকে বসতে বলি না; শুধু জিজ্ঞেস করি ও কেমন আছে। ও জানায় ভালো আছে, কিন্তু একলা লাগছে; আসার সময় একটিও বই আনে নি, মনে হয়েছিলো পড়তে পারবে না; কিন্তু এখন কয়েকটি বই পেলে ওর সময় সুন্দরভাবে কাটতো। আমি ওকে আমার পড়ার ঘরে নিয়ে যাই, বইয়ের আলমারিগুলো খুলে দিই। এতো বই ও কখনো দেখে নি, দেখে ওর চোখ থেকে আলো বেরোতে থাকে। আমি শেলফ থেকে একটির পর একটি বই নামিয়ে দিতে থাকি, বইগুলোর নাম দেখে দেখে ও দু-হাতে বুকে চেপে ধরতে থাকে; বুক ভরে যাওয়ার পর বইগুলো নামিয়ে রেখে আমার হাত থেকে আরো বই নিতে থাকে। আমি আলমারি খালি করে ফেলতে থাকি; ও যে এতো বই পড়তে পারবে না, আমার মনে থাকে না; বই নামাতে আমার ভালো লাগে।
মেয়েটি বলে ওঠে, খালু, আপনার এতো বই!
আমি বলি, তুমি আমাকে খালু বলবে না।
মেয়েটি চমকে ওঠে, দীন মুহাম্মদের মতো ভয় পায় না।
সে জানতে চায়, কেনো?
আমি বলি, আব্বা, বাবা, কাকা, খালু এসব ডাক আমি পছন্দ করি না।
মেয়েটি বলে, কেনো পছন্দ করেন না?
আমি বলি, আমি কারো আব্বা, চাচা, খালু হতে চাই না।
মেয়েটি বলে, তাহলে আপনাকে কী ডাকবো?
আমি বলি, দীন মুহাম্মদ যা ডাকে তুমি তাই ডাকতে পারো।
মেয়েটি একটু বিষণ্ণ হয়, জিজ্ঞেস করে, স্যার?
আমি কথা বলি না, মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আবার কয়েক দিন দেখি নি মেয়েটিকে। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর একটু শুয়ে আছি, শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না, একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে; শুনতে পাই মেয়েটি দরোজায় টোকা দিয়ে বলছে, স্যার, আমি কি ভেতরে আসবো?
আমি বলি, এসো।
ভেতরে ঢুকে ও সালাম দেয়, আস্তে আস্তে আমার দিকে এগোয়, মুখে ওর নিজস্ব হাসিটি, এবং হাতে কয়েকটি বই।
মেয়েটি বলে, স্যার, বইগুলো পড়া হয়ে গেছে, তাই এলাম।
আমি বলি, বসো।
মেয়েটি বলে, আমি এভাবেই ভালো আছি, স্যার, দাঁড়িয়ে কথা বলতেই আমার ভালো লাগে।
আমি আবার বলি, বসো।
মেয়েটি বিব্রত হয়ে বলে, আপনার সামনে বসতে আমার সাহস হবে না।
কথাটি শুনতে আমার ভালো লাগে। ওর চলতি বাঙলাটিও ভালো লাগে, মাঝেমাঝেই ওর চলতি উচ্চারণের মধ্যে আঞ্চলিক ঢুকে ওর কথাগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে।
আমি বলি, তুমি বসো।
মেয়েটি চেয়ারের দিকে তাকিয়ে যেনো ভয় পায়, বলে, আপনার সামনে আমি চেয়ারে বসতে পারবো না, স্যার।
আমি বলি, তাহলে বিছানায়ই বসো।
মেয়েটি বিছানায় আমার পায়ের দিকে বসে, বিব্রত হয়ে হাসে, ওর ঠোঁটের মাংস ফুলে ওঠে; আর অমনি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে টেলিফোন বেজে ওঠে।
আমি বলি, হ্যালো।
ডলি বলে, তোমাকে আমি ভুলে যাই নি, তুমিও আমাকে ভুলে যাবে তা আমি হতে দেবো না, তুমি মনে রেখো।
আমি বলি, ডলি, এখন আমি একটি সুন্দর সময় কাটাচ্ছি, সত্যিই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
ডলি বলে, আমার সঙ্গে কথা বলতে তোমার ইচ্ছে করবে কেনো? তোমার ইচ্ছে করবে কোনো বুড়ীর সাথে কথা বলতে। হয়তো কোনো একটা বুড়ীকে শোয়ানোর ফন্দি করছে; এর চেয়ে সুন্দর সময় তুমি কোথায় পাবে?
আমি বলি, তুমি কি এর জন্যেই ফোন করেছো?
ডলি বলে, তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো ভাবছি।
আমি বলি, তোমার ভাবনার ওপর আমার কোনো হাত নেই।
ডলি বলে, কিন্তু আমার মনে হয় তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি সুখী হবে, তোমাকে আমি ওই সুখটা দিতে চাই না।
আমি বলি, আমি কখনো সুখী হতে চাই নি, সুখের মতো সামান্য জিনিশ আমি চাই না।
ডলি বলে, তোমার মুখে আমি থুতু দিই।
ডলি ফোন রেখে দেয়।
আমি মেয়েটিকে বলি, আমার স্ত্রী ফোন করেছিলো।
মেয়েটি বলে, তিনি কোথায় থাকেন?
আমি বলি, লন্ডনে।
আমার মনে হয় মেয়েটি আরো কথা বলতে চায়, আমাদের সম্পর্কে ওর মনে আরো অনেক কথা জমে গেছে, কিন্তু বলে না।
আমি বলি, তুমি কি আরো কিছু জানতে চাও?