আমি বলি, তাহলে তো বেশ কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
হালিমা বেগম বলেন, তয় আমার প্যাটের জিনিশটা কাজির না, কাজির মাইজ্যা পোলারই।
বাসায় ফিরে বোতল থেকে চুমুক দিয়ে একটু পান করার সময় মনে পড়ে দীন মুহাম্মদের মেয়ের চোখের অপারেশনটা কি হয়ে গেছে? ক-তারিখে হবে বলে যেনো দীন মুহাম্মদ বলেছিলো? সে কি আমাকে বলেছিলো? নিশ্চয়ই বলেছিলো; হয়তো একবারের বেশি বলতে সাহস করে নি, তাই আমার মনে নেই। মেয়েটি ক্লাশে ফার্স্ট হয়? ফার্স্ট হয়ে কী হবে? কতো মেয়েই ফার্স্ট হয়, আরো কতো মেয়েই তো ফার্স্ট হতে পারতো। কতো নম্বর কেবিনে আছে মেয়েটি? আমি বলে দিয়েছি, কেবিনেই রাখবে মেয়েটিকে, কিন্তু কত নম্বর কেবিন? দীন মুহাম্মদ কি আমাকে কেবিনের নম্বর বলেছিলো? নিশ্চয়ই বলেছিলো; দীন মুহাম্মদকে কয়েক দিন ধরে উদ্বিগ্ন দেখছি না, খুশিখুশি দেখছি, মেয়েটি কেবিনেই আছে। কিন্তু কতো নম্বর? আমার কি মেয়েটিকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে না, দীন মুহাম্মদের মেয়ে কোন কেবিনে পড়ে আছে, তা নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। পরপর চারটি ফোন এলো; আমার এ-সন্ধ্যায় দু-জায়গায় নিমন্ত্রণ রয়েছে; আমি বারবার বলছি, না, না, অত্যন্ত দুঃখিত, কোনো নিমন্ত্রণেই আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। বাসায় বসে থাকতেও কি আমার ইচ্ছে করছে? আমি হাসপাতালে ফোন করি। অভ্যর্থনায় করি না, সেখানকার মেয়েগুলো আমাকে চিনবে না; আমি বড়ো ডাক্তারটিকেই করি; ফোন পেয়ে সে পাগল হয়ে ওঠে; জানায় যে রোকেয়ার অপারেশন হয়ে গেছে, খুব ভালো অপারেশন হয়েছে, কোনো চিন্তার কারণ নেই, তিনি নিজেই করেছেন, তার দেখাশোনার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না, একটি নার্স সব সময় তার পাশে থাকছে; সে পনেরো নম্বর কেবিনে আছে, ভিআইপি কেবিন। আমার হাসি পাচ্ছে। মেয়েটির তো দু-চোখে পর্দা পড়ে চোখ দুটি বুজে যাওয়ার কথা। দীন মুহাম্মদের মেয়ের বড়ো জোর বারান্দায় পড়ে থাকার অধিকার আছে। তার বেশি অধিকার তাকে আমরা দিই নি; দেবো না। কিন্তু সে এখন কেবিনে? এই কেবিনে থাকা কি তার সারাটি জীবনকে নষ্ট করে দেবে না? সে কি মনে করবে না দেশ তার জন্যে কেবিনের ব্যবস্থা করে রেখেছে? আমার হাসি পাচ্ছে। কয়েক বছর পর যদি আমার দরকার হয়, আমি কি ভিআইপি পাবো? একটা নার্স সব সময় আমার দেখা শোনা করবে? দীন মুহাম্মদ এসে দরোজায় শব্দ করছে, খাবো কি না জানতে চাচ্ছে; আমি কিছু বলছি না। আমি বেরোচ্ছি। দীন মুহাম্মদকে বলি যে আমি একটু বাইরে বেরোচ্ছি; সে জানায় যে ড্রাইভার নেই; না থাকায় আমি স্বস্তি পাই। আমি একটি রিকশায় উঠি, লোকটি কোথায় যাবো জানতে চাইলে আমার কোনো জায়গার নাম মনে পড়ে না, এবং হাসপাতালটির নাম মনে পড়ে; আমি হাসপাতালটির নাম বলি। পনেরো নম্বর কেবিনে ঢুকে দেখি মেয়েটি শুয়ে আছে, তার ডান চোখটি বাঁধা।
তুমি কি দীন মুহাম্মদের মেয়ে? বলতে গিয়ে আমি থেমে যাই; মেয়েটির খোলা একটি চোখ আর চুলের দিকে তাকিয়ে, শুয়ে থাকার ভঙ্গি এবং একটি হাতের আঙুলগুলো দেখে দীন মুহাম্মদকে আমি দীন মুহম্মদ বলতে পারি না; আমি বলি, তুমি কি দীন মুহাম্মদ সাহেবের মেয়ে?
মেয়েটি উঠে বসতে চায়, নার্স তাকে বসতে দেয় না।
মেয়েটি বলে, জি।
আমি বলি, তোমার নাম কি রোকেয়া?
মেয়েটি আবার উঠে বসতে চায়, নার্স তাকে বসতে দেয় না।
মেয়েটি বলে, জি।
আমি বলি, তুমি ভালো আছো?
মেয়েটি বলে, জি।
আমি বলি, আচ্ছা, এখন চলি।
মেয়েটি বলে, আপনি কে; আব্বাকে কী বলবো?
আমি বলি, কিছু বলতে হবে না, তুমি ঘুমাও।
দু-দিন পর বারান্দা থেকে দেখতে পাই দীন মুহাম্মদ মেয়েকে নিয়ে দেয়ালের পাশে তার ঘরটিতে ঢুকছে। দীন মুহাম্মদের ঘরটি কেমন আমি কখনো দেখি নি। কিছুক্ষণ পর দীন মুহাম্মদ আসে।
দীন মুহাম্মদ বলে, স্যার, মাইয়ার চোখ ভাল অইয়া গেছে, হাসপাতাল থেইক্যা, লইয়া আইলাম, তয় আরো একমাস থাকতে অইব।
আমি বলি, তোমার মেয়ে কোথায় থাকবে।
দীন মুহাম্মদ বলে, আমার ঘরেই থাকব, স্যার।
আমি বলি, তোমার মেয়ে কি তোমার ঘরে থাকতে পারবে? কেবিনের পর কি ওই ঘর ভালো লাগবে?
দীন মুহাম্মদ বলে, অর ত কেফিনে থাকনের কতা আছিল না, স্যার, আপনের দয়ায় সেইটা অইছে।
আমি বলি, তোমার মেয়েকে একবার ডাকতে পারবে?
দীন মুহাম্মদ বেশ দ্রুত বেরিয়ে যায়, এতোটা সে আশা করে নি; এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। দীন মুহাম্মদের পেছনে তার মেয়ে, রোকেয়া, শালোয়ার কামিজপরা; আমাকে দেখেই সে চমকে ওঠে; আমি তার চমকানোটা উপভোগ করি। দীন মুহাম্মদ বারবার মেয়েটিকে সালাম করতে বলে, রোকেয়া আমাকে সালাম করার জন্যে মাথা নিচু করে, আমি তাকে ধরে রাখি, সে সালাম করতে পারে না। আমি তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে আনি; মনে হচ্ছিলো দীর্ঘ সময় ধরে তাকে আমি ধরে আছি। এই মেয়ে দীন মুহাম্মদের? কোনো সেকরেটারির নয়? চারপাশের সেকরেটারিদের মেয়েগুলোকে দেখে আপনা থেকেই আমার চোখ বুজে আসে, তাই এ-বয়সেও সাধারণত তাদের দিকে তাকাই না; কিন্তু আমি দীন মুহাম্মদের মেয়েকে দেখি।
আমি বলি, রোকেয়া, তুমি এখন ভালো আছো?
রোকেয়া বলে, জি, ভালো আছি।