মোনাজাতের পর আমি হালিমা বেগমের খিলখিল হাসি শুনতে পাই। হাসিটার রঙ আমি দেখতে পাই–টকটকে লাল হাসি; হাসিটা তিনি আমাকেই শোনাতে আর দেখাতে চাচ্ছেন; কাজি অনেক দূরে আছে, তার কানে আর চোখে হাসিটা পৌঁছোবে না; হালিমা বেগম তা চান না।
খিলখিল করতে করতে হালিমা বেগম জিজ্ঞেস করেন, আনিছ ভাই, হাত উড়াইয়া ঠোঁট লড়াইয়া আপনারা কি কইলেন আল্লারে?
আমি বলি, আল্লাকে কিছু বলতে হয় না, তিনি এভাবেই সব কিছু জানেন।
হালিমা বেগম বলেন, দ্যাশের পুলিশগুলিন যেইভাবে মাইয়ালোক পাইলেই নিজেগো বিবি ভাইব্যা যা-তা করতাছে, আল্লারে সেই কথা কন নাই?
আমি বলি, কাজি হয়তো বলেছে।
হালিমা বেগম বলেন, কাজির কথা আমিই শুনি না, আল্লা কি শুনবো?
আমি বলি, আল্লা পরম করুণাময়, তিনি সবার কথা শোনেন।
জেনারেল হেলিকপ্টারে উড়ে চলে যায়। আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করছি, হঠাৎ কাজির গাড়ি এসে আমার গাড়ির পাশে থামে। কাজি সমস্যায় পড়েছে, সে আবার পীরের মাজার জিয়ারত করতে চায়, কিন্তু হালিমা বেগম মাজারে যেতে চাচ্ছেন না; তাঁর আর পীরের পুণ্যনগরে থাকতে ইচ্ছে করছে না; তাঁর ভয় হচ্ছে কাজি তাঁকে গাড়িতে বসিয়ে মাজার জিয়ারত করতে করতে রাত করে ফেলবে। হালিমা বেগম চাচ্ছেন তাড়াতাড়ি ঢাকা ফিরে যেতে, কাজির মেজো ছেলেটির জন্যে হয়তো তাঁর সৎমাতৃহৃদয় কাঁদছে; তিনি চাচ্ছেন আমার সাথে ঢাকা ফিরতে, তাঁর সওয়াবের দরকার নেই। কাজিও আমাকে অনুরোধ করে হালিমা বেগমকে আমার সাথে নিয়ে যেতে, যাতে কাজি প্রাণভরে জিয়ারত করতে পারে। আমরা ঢাকা চলে আসি, মাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় হালিমা বেগম খিলখিল হাসতে থাকেন; তার হাসিতে আমি কোমল স্নিগ্ধ উত্তেজনা বোধ করি, আমার ভালো লাগে, আমি সেটাকে বাড়তে দিই না, গোপন করে রাখি, নিজের শরীরে স্তব্ধ করে রাখি, এবং মনে করতে থাকি যা গোপন তা-ই নিষ্পাপ। হালিমা বেগমকে আমি নিষ্পাপভাবে কাজির বাসায় পৌঁছে দিই।
রাত বারোটার দিকে টেলিফোন বেজে ওঠে; পুণ্যনগরের ডিসি কথা বলছে।
ডিসি বলে, স্যার, আমি আবদুর রহমান মিয়া বলছি, স্যার।
আমি বলি, বলুন।
সে বলে, একটা দুঃসংবাদ আছে স্যার, কাজি স্যারের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, স্যার।
আমি জানতে চাই, কোথায়?
সে বলে, পীরের মাজার থেকে মাইলখানেক দূরে, স্যার, একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি কলিশন হয়, স্যার।
আমি জানতে চাই, কাজি এখন কেমন আছে?
সে বলে, কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন, স্যার।
আমার বলতে ইচ্ছে করে, ইন্তেকালের অর্থ কী আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন, কিন্তু আমি বলি, আচ্ছা।
সে বলে, কাজি স্যারের স্ত্রী আপনার সাথে গেছেন, স্যার।
বলতেই লাইনটা কেটে যায়। আবদুর রহমান মিয়া কি ইচ্ছে করেই লাইনটি কেটে দিলো? সে কি মনে করছে কাজির স্ত্রী এখন আমার সাথেই আছে?
আবার ফোন বাজে, আবদুর রহমান মিয়া বলে, আমি খুব দুঃখিত, স্যার, লাইনটা কেটে গিয়েছিলো, স্যার, কাজি স্যারের স্ত্রীকে সংবাদটা জানাতে আমি ভয় পাচ্ছি, স্যার, তিনি হয়তো ভেঙে পড়বেন, স্যার।
আমি বলি, আচ্ছা, আমি জানাবো।
এ-মধ্যরাতে কাজির অ্যাক্সিডেন্ট আর ইন্তেকালের সংবাদ পেলে কি খুশি হবেন হালিমা বেগম? তার ঘুমের থেকে এই সংবাদ কি বেশি মূল্যবান? তিনি কি মধ্যরাতে টেলিফোন ধরেন? আমি টেলিফোন করবো তাকে? কীভাবে আমি তাকে সংবাদটি দেবো? এর আগে কখনো আমি কাউকে মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছি? কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে কোন দোয়াটি যেনো পড়তে হয়? আমি কি সেটা পড়েছি? কোনটা পড়তে হয়, কোনটা? এমন সময় আবার টেলিফোন বেজে ওঠে। ডিসি কি আবার ফোন করলো? এবার কি সে বলবে কাজি বেঁচে উঠেছে? আমলাতান্ত্রিক ভুলবশতই সে আগের সংবাদটি দিয়েছিলো? এখন সে ক্ষমা চাচ্ছে।
টেলিফোন ধরতেই শুনতে পাই, আমি ডলি বলছি।
আমি বলি, অনেক দিন পর ফোন করলে?
ডলি বলে, আজকাল কি নিজের বাসায় ঘুমোও না? মিস্ট্রেসের বাসায়ই ঘুমোচ্ছা, না কি?
আমি বলি, মিস্ট্রেস থাকলে তার বাসায়ই ঘুমোতাম, কিন্তু আমি অতো ভাগ্যবান নই, আজো কোনো মিস্ট্রেস পাই নি।
ডলি বলে, তাহলে পাওয়ার চেষ্টা করছো?
আমি বলি, আমি তোমার জন্যে আর আমার জন্যে দুঃখ পাই, ডলি।
ডলি বলে, কেনো দুঃখ পাও?
আমি বলি, তোমাকে আমি একটি ক্ষ্যাপা নারীতে পরিণত করেছি বলে। শক্তি থাকলে তোমাকে আমি সেই ছোট্ট বালিকাটি করে দিতাম, যে মধুর ছিলো, মিষ্টি ছিলো।
ডলি বলে, তোমার এসব বাজে কথা শোনার সাধ নেই আমার। আমি জানতে চাই দু-রাত ধরে কোন মিস্ট্রেসের বাড়ি ঘুমোচ্ছা?
আমি বলি, আমি যেখানেই ঘুমোই তোমার কিছু আসে যায় না, যেমন তুমি যেখানেই ঘুমোও আমার কিছু আসে যায় না।
ডলি বলে, এই ক-মাস তুমি কারো সাথে ঘুমোও নি, দেবতাটি হয়ে আছো, এটা কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
আমি বলি, তোমাকে আমি কিছুই বিশ্বাস করতে বলি না।
ডলি বলে, তোমার গলার আওয়াজ শুনেই আমি বুঝতে পারছি আজ সন্ধ্যায়ই তুমি কোনো মেয়েলোকের সাথে শুয়েছে।
আমি বলি, ডলি, তুমি ভালো নেই।
ডলি বলে, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করেছে, তোমাকে আমি ছাড়ছি না।
ডলি ফোন রেখে দেয়।
আমার একটি চমৎকার অভ্যাস হয়েছে, চমৎকার বলেই আমার মনে হচ্ছে; বালিশের নিচে আমি একটি হুইস্কি বা ব্র্যান্ডির বোতল রেখে দিই, যখন ইচ্ছে করে ছিপি খুলে এক চুমুক খাই, খেতে খেতে ছিপিটা বন্ধ করি, বন্ধ করতে করতে আরেক চুমুক খেতে ইচ্ছে করে, আস্তে আস্তে ছিপি খুলি, আরেক চুমুক খাই। জিভের নিচে কখনো একটু মিষ্টি স্বাদ লেগে থাকে, কখনো টক স্বাদ, অনেকক্ষণ ধরে জিভ এদিক সেদিক নেড়ে ওই স্বাদটা আমি চুষে নিই। গ্লাশে ঢেলে খেতে আমার ইচ্ছে করে না। গ্লাশে ঢাললে স্থির হয়ে বসে দায়িত্ব পালনের মতো খেতে হয়, মনে হয় কোনো ফাইল নিয়ে বসেছি, এখনি দরোজা ঠেলে বা ফোন বাজিয়ে কোনো তদবির ঢুকবে; এবং মনে হয় আমি মাতাল, একটু পরেই রাস্তায় নেমে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে থাকবো, যাকে পাবো তার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইবো, ঝরঝর করে কাঁদবো। ছিপি খুলে চুমুক দেয়ার অভ্যাস যে আমার চিরকাল থাকবে, তা মনে হয় না; কেনোইবা আমি একটি অভ্যাস সব সময়ের জন্যে বয়ে চলবো? ওই অভ্যাসের সঙ্গে আমার কোনো চুক্তি হয় নি; আমি কোনো চুক্তিতে বাঁধা পড়তে চাই না। আজ অফিস থেকে ফিরে, খাওয়ার আগে, কয়েকবারই বোতলের ছিপি খুলেছি; এটার স্বাদ একটু মিষ্টি, আমার বারবার ছিপি খুলতে ইচ্ছে করছে। লোকটির কী যেনো নাম?–দীন মুহাম্মদ?–সে এসে দরোজায় শব্দ করছে, আমি তাকে ঢুকতে বলি। সরাসরি বোতল উল্টে খাচ্ছি দেখে সে অবাক হয়, একটি গ্লাশ এনে আমার সামনে রাখে।