দেলোয়ারের বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?
আমি বলি, আমি দেলোয়ারের সাথে যাচ্ছিলাম।
তিনি বলেন, তুমি যাবে বলে তো জানতাম না।
আমি বলি, ওরা আমাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে।
তিনি এবার জানতে চান, তুমি গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো?
আমি বুকে একটা আঘাত বোধ করি। আমি তাঁকে বলতে পারি না যে গাড়িতে মাংসমেশানো সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাই আমি গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তিনি দেলোয়ারের সাথে আমাকেও নদীর গর্ভে দেখতে চাচ্ছেন; আমি সেখানে নেই বলে কষ্ট পাচ্ছেন। তার চোখ দেখে আমি অপরাধ বোধ করি; ইচ্ছে হয় দেলোয়ারের সাথে ডুবে যাই, আর লাশ হয়ে দেলোয়ারকে জড়িয়ে ধরে ভেসে উঠি।
আমি তাকে বলি, গাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
তিনি বলেন, তাই তুমি বেঁচে আছে।
একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, ডলি কি তোমার সাথেই গাড়ি থেকে নেমেছিলো?
আমি বলি, না।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, ডলি কখন নামে?
আমি বলি, আমি নামার একটু পরে।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি ডলিকে আগে থেকেই চিনতে?
আমি প্রায় হ্যাঁ বলে ফেলেছিলাম; কিন্তু বলার একটু আগে আমার মনে পড়ে ডলিকে আমি আগে থেকে চিনতাম না, এখনো চিনি না।
আমি বলি, না।
তিনি বলেন, তাহলে তোমরা দুজন গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো?
আমি কোনো উত্তর দিই না; দেলোয়ারের বাবা যেনো আমার উত্তর পেয়ে গেছেন এমনভাবে নিচ দিকে ও চারদিকে তাকান; আমার মুখের দিকে আর তাকান না; যেখানে লোকজন ডলিকে ঘিরে আছে, সেদিকে হাঁটতে থাকেন। আমি অন্য কোনো দিকে যেতে পারি না; মনে হয় দেলোয়ারের বাবা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি তাঁর হাত থেকে ছুটতে চেষ্ট করছি, কিন্তু ছুটতে পারছি না, এমনভাবে তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। দূর থেকে আরেকবার আমি ডলির মুখ দেখি; তাতে আমি কষ্ট দেখতে পাই না; একধরনের গোপন শান্তি দেখতে পাই, ওই শান্তির ওপর একটা হাল্কা অপরাধের ছায়া দেখতে পাই। আমার মুখেও কি অন্যরা অমন কোনো গোপন শান্তি দেখতে পাচ্ছে? তার ওপর দেখতে পাচ্ছে লঘু অপরাধের ছায়া? আমি মাংসমেশানো গন্ধটা আবার পেতে থাকি, তবে এবার আমার দম বন্ধ হয়ে আসে না; আমি গন্ধটা প্রাণপণে বুকের ভেতর নেয়ার জন্যে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস নিই; সুগন্ধে আমার বুক ভরে ওঠে। তারপরই দেলোয়ারের অভাব আবার বোধ করি। গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া আমার ঠিক হয় নি, গাড়িতে থাকলেই ভালো হতো বলে মনে হয়। আমার মুখে, আমি নিজেই টের পাই, অপরাধের ছাপটি বেশ ঘন হয়েই লেগেছে; এখন সবাই নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে। আমিও আমার মুখটি চারদিকে দেখতে পাচ্ছি, অপরাধবোধের একটি কালো প্রলেপ লেগে আছে আমার মুখটিতে।
দেলোয়ারের মা ডলিকে জিজ্ঞেস করছেন, বউ, তুমি গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো?
ডলি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে; তিনি আবার ওই প্রশ্ন করেন। ডলি কোনো উত্তর দেয় না; দেলোয়ারের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ডলি কী যেনো পড়ার চেষ্টা করে।
ডলি অনেকক্ষণ ধরে পড়ে,–ডলি যেভাবে তাকায় তাতে পড়ার কথাই আমার মনে হয়; পড়া শেষ হলে চুপ করে থেকে শেষে ডলি বলে, আমার ভয় করছিলো।
তিনি বলেন, স্বামীর সাথে থাকতে মেয়েলোকের কী ভয়?
‘স্বামী’ শব্দটি শুনে আমার যেনো কেমন লাগে, ডলিকে আমার নোংরা মনে হয়।
ডলি বলে, মনে হচ্ছিলো আমি মরে যাবো।
তিনি বলেন, স্বামীর সাথে মরতে পারাও তো মেয়েলোকের ভাগ্য; তোমার সেই ভাগ্যও হলো না।
ডলি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, আনিসের সাথে তোমার আগে থেকে জানাশোনা ছিলো?
ডলি প্রথম আনিস নামটি মনে করতে পারে না বলে আমার মনে হয়; পরে আমার দিকে তাকিয়ে নামটি তার মনে পড়ে। সে অনেকক্ষণ দেলোয়ারের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ডলি বলে, হ্যাঁ; ছিলো।
ডলির কথা শুনে আমি চমকে উঠি।
দেলোয়ারের মা জিজ্ঞেস করেন, তাই তোমরা গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলে?
ডলি বলে, না।
তিনি বলেন, তাহলে নামলে কেনো?
দেলোয়ারের মা এবার আমার দিকে এগিয়ে আসেন; এবং জিজ্ঞেস করেন, বউর সাথে তোমার আগে থেকেই পরিচয় ছিলো?
আমি ডলির দিকে একবার তাকাই; তখন আমার দেলোয়ারের কথা আর মনে পড়ে; ডলি আমার দিকে তাকিয়ে নদীর দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
আমি বলি, হ্যাঁ; পরিচয় ছিলো।
তিনি বলেন, তাই তোমরা গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
তিনি বলেন, এজন্যেই দেলোয়ার খুব জোরে গাড়ি চালিয়েছিলো?
আমি বলি, ফেরিতে ওঠার সময় সবাই জোরে গাড়ি চালায়।
তিনি বলেন, দেলোয়ার অন্যদের মতো না; আমার দেলোয়াররে আমি চিনি।
আমি পোন্টুনের অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করি। দেলোয়ারের ভাই ও বোনটিকে দেখে আমি গোপনে ভয় পাই; ভাইটি আমার ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে-বেশ চমৎকার পেশি ছেলেটির। লাফিয়ে পড়তে পারে ডলির ওপরও; এটা ডলির বাবা, ভাইবোন, আর ডলির অন্যরা টের পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে; তারা বেশ নিবিড়ভাবে ডলিকে ঘিরে আছে। তারা ডলিকে কোনো প্রশ্ন করছে না। তাদের চোখেমুখে আমি একধরনের শান্তি আর উদ্বেগ দেখতে পাই। ডলির ছোটো বোনটি ডলিকে জড়িয়ে ধরে আছে;–কেউ ডলিকে ছিনিয়ে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে, এমন একটা উদ্বেগ তার দু-বাহু দিয়ে বয়ে চলছে। তার মুখেও একটা শান্তির ছাপ লেগে আছে। একবার আমার মনে হয় শুধু আমারই কেউ নেই, আমাকে নিবিড়ভাবে ঘিরে রাখার মতো কেউ নেই। দেলোয়ারের গাড়ি খোঁজার জন্যে ডুবুরিরা পানিতে নেমেছে; তাদের ডুব দেখতে আমার ভালো লাগছে। আমি দেলোয়ারের মুখটি মনে করার চেষ্টা করি; কিন্তু তার মুখ মনে করতে পারি না; বারবার ডলির মুখটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দেলোয়ার দেখতে কেমন ছিলো? তার কি গোঁফ ছিল? চুল চমৎকারভাবে কাটা ছিলো? কপালে একটা ছোট্ট দাগ ছিলো? আমি কেনো কিছুই মনে করতে পারছি না।