তবু আমি বলি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
দারোগা আমার দিকে প্রভুর মতো তাকায়; আমার মনে হতে থাকে এখন সে যে-কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে; এবং সে যে-সিদ্ধান্তই দেবে, তা-ই ঠিক সিদ্ধান্ত। আমি তার সিদ্ধান্ত মেনে নেবো, কেননা তাতে কোনো ভুল হতে পারে না।
দারোগা বলে, আপনি সুস্থ নন।
আমি চারপাশের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সবাই বড়ো দারোগার সাথে একমত; এমন কি ডলির মুখও বলছে আমি সুস্থ নই।
বড়ো দারোগা আমার সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে; ডলির সম্পর্কে তার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি। ডলির সম্পর্কেও তার সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।
বড়ো দারোগা ডলিকেও জিজ্ঞেস করে, আপনি বাইরে বেরিয়েছিলেন কেনো?
ডলি বলে, গাড়িতে আমার ভয় করছিলো।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, কেনো ভয় করছিলো?
ডলি বলে, মরে যাওয়ার ভয় করছিলো।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, আপনাদের না নতুন বিবাহ হয়েছিলো?
ডলি বলে, হ্যাঁ।
বড়ো দারোগা বলে, তাহলে কেনো ভয় করলো?
ডলি কোনো উত্তর দেয় না; সে একবার নদীর দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। বড়ো দারোগা ডলি আর আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তার চোখ দেখে মনে হয় নতুন বিয়ে হলে স্বামীর সাথে গাড়ি করে ফেরিতে উঠতে ভয় পাওয়া আইনসম্মত নয়, নীতিসম্মত নয়।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, আপনি কি জানতেন দুর্ঘটনা ঘটবে?
ডলি বলে, না।
বড়ো দারোগা বলে, তাহলে আপনি ভয় পাচ্ছিলেন কেনো?
ডলি বলে, জানি না; কিন্তু আমার ভয় করছিলো।
ডলির থেকে যা জানার বড়ো দারোগার জানা হয়ে গেছে; সে এবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের মধ্যে কে আগে নেমেছিলেন?
আমি বলি, আমি।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, আপনাদের কি আগে থেকে পরিচয় ছিলো?
আমি কিছু বলার আগে ডলি উত্তর দেয়, না।
বড় দারোগা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না কেনো?
আমি বলি, দিতে দেরি হয়ে গেছে।
বড়ো দারোগা বলে, এতো দেরি স্বাভাবিক নয়।
দেলোয়ার ভেসে ওঠে নি; সবাই সম্ভবত অপেক্ষা করছিলো দেলোয়ার ভেসে উঠে সকলের কৌতূহল মেটাবে; বিশেষ করে দারোগা আর পুলিশরা সরকারি দায়িত্ব হিশেবেই দেলোয়ারের লাশটির ভেসে ওঠার প্রত্যাশা করছিলো। পারলে তারা লাশটিকে ভেসে ওঠার আদেশ দিতো। তাহলে সরকারের অপচয় বাঁচতো; কিন্তু দেলোয়ার তাদের প্রত্যাশা পূরণ করে নি। দারোগার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি দেলোয়ারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম; মনে করতে পারছিলাম না আমি কেনো ফেরির ওপর দাঁড়িয়ে আছি, আমার সামনে কেনো দারোগা আর পুলিশ, আর কেনোই বা একটি নারী আমার পাশে। দেলোয়ার ভেসে ওঠে নি; তাই ফেরিটি এখন ছাড়বে; বড়ো দারোগা আমাদের কাছে জানতে চায় কোথায় খবর দিতে হবে। কোথায় খবর দিতে হবে, আমি জানি না; ডলি জানে। আমি ডলির দিকে তাকাই; ডলি তাদের গ্রামের ঠিকানা বড়ো দারোগাকে লিখে দেয়। বড়ো দারোগার সাথে ডলি আর আমি পোন্টুনে ফিরে আসি; ফেরিটি ছেড়ে দেয়। ডলির দিকে তাকিয়ে আমি অপরাধ বোধ করতে থাকি। ডলিকে অদ্ভুত দেখাতে থাকে; মনে হয় ডলি এখন কাঁদতো, কিন্তু কাঁদতে পারছে না; বড়ো দারোগা বা এই নদী বা আমার সামনে সে নিজের বা দেলোয়ারের জন্যে কাঁদতে পারবে না।
দেলোয়ারের গাড়িটি উঠোনোর জন্যে একটি উদ্ধারকারী জাহাজকে খবর পাঠানো হয়েছে। পাঠানো হয়েছে? আমি জানি না; আমার মনে হয় খবর পাঠানোই নিয়ম, নিশ্চয়ই পাঠানো হয়েছে। কোনো জাহাজ এসে পৌঁছে নি। আমার কোনো তাড়া নেই; ডলিরও কোনো তাড়া নেই-সে পোন্টেনের এককোণে গিয়ে এমনভাবে বসেছে যে বোঝা যাচ্ছে তারও কোনো তাড়া নেই; খুব শিগগির সে কোনো তাড়া বোধ করবে না। কোনো জাহাজ আসে নি; তবে পুলিশরা খুবই দক্ষ-দলে দলে ডলিদের বাড়ি থেকে লোকজন এসে পৌঁচোচ্ছে; আমি অবশ্য তাদের কাউকেই চিনি না। তারা আসার পরই আমি প্রথম শোকের চাপ বোধ করতে শুরু করি;–তারা চিৎকার আর অশ্রুতে চারপাশ মুখর ও ভারাক্রান্ত করে আসতে থাকে; আমি ওই চিৎকার শুনে হঠাৎ এক প্রচণ্ড অভাব বোধ করি। আমার মনে হতে থাকে দেলোয়ার নেই, দেলোয়ারকে আমি আর কখনো দেখবো না; পরিচিত কারো সাথে দেখা হলেই দেলোয়ার আর আমার কথা বলবে না, আমিও তার কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাবো। ডলিদের বাড়ির লোকজন আমাকে চেনে না বলেই আমার কাছে কেউ আসছে না; সবাই ডলিকে ঘিরে ধরছে, ডলি কোনো কথা বলছে না। একবার আমার মনে হয় আমি খুব দূরে গিয়ে দাঁড়াই, কিন্তু দূরে যেতে পারি না; বরং ভিড় ঠেলে একটু একটু করে ডলির বেশ কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই। মেয়েরা ডলিকে জড়িয়ে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে কাঁদার চেষ্টা করছে, বা ডলিকে কাঁদাতে চাচ্ছে; কিন্তু ডলি কাঁদছে না। আমি দেখতে পাই ডলি চোখ দিয়ে কী যেনো খুঁজছে; এক সময় তার চোখ এসে আমার চোখের ওপর পড়ে; ডলি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে।
আমি অন্য দিকে তাকাই; আর তখনই দেখি দেলোয়ারের বাবা, মা, একটি বোন, আর একটি ভাই জড়াজড়ি করে কেঁদে কেঁদে ফেরি থেকে নামছে। আমি তাদের দিকে এগিয়ে যাই, দেলোয়ারের বাবাকে জড়িয়ে না হলেও ধরার চেষ্টা করি। তাকে আমি ঠিকমতো ধরতে পারি না; আমার মনে হয় তিনিই আমাকে ধরতে দিচ্ছেন না; আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। তারা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান; ডলির দিকে আর এগোন না। দেলোয়ারের মা একবার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান, কিন্তু পারেন না; তাঁকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে দেলোয়ারের ভাইটি ও বোনটি। দেলোয়ারের বাবা লাফিয়ে পড়তে চাচ্ছেন না; সম্ভবত পুরুষ হওয়ার অসুবিধা এই যে সব কাজ তাদের মানায় না; শেষ সিদ্ধান্ত তারা সহজে নিতে পারে না। আমি সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকি, সেখানে আমি কিছুই খুঁজি না; শুধুই তাকাই; অনেকের মুখেই আমি বেদনা দেখতে পাই; ডলির মুখের দিকে তাকাতেই আমি বেদনার বদলে অপরাধবোধ দেখতে পাই। ডলি কি কষ্টের বদলে অপরাধে ভুগছে? সে যে দেলোয়ারের সাথে গাড়িতে থাকে নি, এটা কি তার কাছে অপরাধ মনে হচ্ছে? সে কি মনে করছে দেলোয়ারের সাথে গাড়িতে থেকে পানিতে ডুবে গেলেই সে ঠিক কাজটি করতো; এবং ঠিক কাজটি করে নি বলে নিজেকে অপরাধী মনে করছে? ডলির মুখে যদি আমি অপরাধের ছাপ দেখতে পাই, তাহলে সবাই আমার মুখে কী দেখছে? আমার মুখ নিশ্চয়ই বেদনায় নীল হয়ে যায় নি; আমি কোনো বেদনা বোধ করছি না, অভাব বোধ করছি দেলোয়ারের; ওই অভাবটা আমার বুকের ভেতরে, মুখে তার কোনো চিহ্ন নেই। আমি যে বেঁচে আছি, এটা অপরাধের মতো মনে হতে চাচ্ছে এখন; ডলির মুখ দেখার পরই এ-বোধটি আমার তীব্র হয়ে উঠছে। আমি কোনো অপরাধ করেছি। আমার তো এখানে থাকারই কথা নয়; এখনো আমি হয়তো পুরোনো প্লেবয়ের পাতা উল্টোতাম, চা খেতাম, সিগারেট টানতাম; দেলোয়ারই তো এখানে আমাকে নিয়ে এসেছে; এবং সে আমাকে অপরাধবোধের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে নিজে চিরনিরপরাধের মতো চলে গেছে। কিন্তু আমি কি কোনো অপরাধ করি নি?