মা একবার পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো–দূর থেকে আমি দেখতে পাই; আমার মনে হয় পড়ে যাক, আমি ধরতে পারবো না; কিন্তু আমি দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলি, মা পুরোপুরি পা পিছলে পড়ে না; আস্তে আস্তে বসে পড়ে। আমার অতো শক্তি ছিলো না যে মাকে উঁচু করে কাঁধে তুলে ধরি, বা ধরে আমার বুকের সাথে আটকে রাখি। ধরতে গিয়ে আমিই নিচে পড়ে গিয়েছিলাম, ব্যথাও পেয়েছিলাম; তবে আমি ব্যথা পেয়েছিলাম কি না মা জানতে চায় নি, তাতে আমার খুব ব্যথা লেগেছিলো। মার শরীরের গন্ধ আমার খুব খারাপ লেগেছিলো।
মা বলেছিলো, তুই না থাকলে আজ আমি মারা যেতাম।
আমি বলেছিলাম, তুমি খুব ব্যথা পেয়েছে।
মা বলেছিলো, মেয়েমানুষের ব্যথা পেতেই হয়, আরো কতো ব্যথা পাবো।
আমি বলেছিলাম, তোমাকে দেখতে আজকাল ভালো লাগে না।
মা বলেছিলো, কেনো রে?
আমি বলেছিলাম, তুমি কুৎসিত হয়ে গেছে।
মা বলেছিলো, আমাকে দেখতে কি খুব কুৎসিত লাগে?
আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ; তুমি কি সুন্দর ছিলে, এখন তোমাকে ভালো লাগে না; এমন কুৎসিত মা ভালো লাগে না।
মা চমকে উঠেছিলো, কষ্টে ভরে-যাওয়া মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, এইজন্যই কি তুই আমার কাছে আসতে চাস না?
আমি কোনো কথা বলি নি, বলার মতো কথাই পাই নি, বলার ইচ্ছে হয় নি। তারপর থেকে মাকে খুব বিব্রত মনে হতে থাকে; আমি নই, মা-ই, আমার মনে হয়, দূরে থাকতে চায় আমার থেকে। কলসি থেকে পানি ঢালার সময় আমাকে ডাকতে গিয়ে মা থেমে যায়, নিজেই ঢালার চেষ্টা করে। আমি দূর থেকে দেখতে পাই মা বসতে পারছে না, কলসি কাৎ করতে পারছে না, তার হাত থেকে গেলাশ পড়ে যাচ্ছে; আমার ইচ্ছে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই, কিন্তু দৌড়ে গিয়ে আমি গেলাশ নিয়ে পানি ঢেলে মাকে দিই। মার মুখে আমি একটি সুন্দর হাসি দেখি, দেখে আমার বুক ভরে যায়, মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে; কিন্তু জড়িয়ে ধরি না। মারও তখন আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেছিলো, কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরতে মা ভয় পায়, মার চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি। মা কেনো কোনো পাখির কাছে থেকে কোনো পরীর কাছে থেকে আমার একটি ভাই বা বোন আনলো না, কেনো মা তার পেটের মধ্যে ভাই বা বোন আনলো? এমন কুৎসিত হয়ে উঠলো?
আমি একদিন জিজ্ঞেস করি, মা, তোমার পেটে কী?
মা একটু বিব্রত হয়; পেটটিকে আঁচল দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বলে, তোর ভাই, নইলে তোর বোন।
আমি বলি, তুমি কেনো পাখি আর পরীর কাছে থেকে ভাইবোন আনলে না?
মা হেসে ওঠে; বলে, পরী আর পাখি কি ভাইবোন দিতে পারে?
আমি বলি, তুমি বলেছিলে পাখি আর পরীর কাছ থেকে আমাকে পেয়েছে।
মা বলে, ছোটোদের তাই বলতে হয়।
আমি বলি, আমাকে পাখি আর পরীর কাছে থেকে পাও নি?
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, না রে না।
আমি বলি, তাহলে কোথায় পেয়েছিলে?
মা বলে, আমার পেটে, তুইও আমার পেটেই হয়েছিলি।
আমি অন্ধকার দেখতে পাই, কোনো কথা বলতে পারি না; শুধু মায়ের বাহু থেকে বেরোনোর চেষ্টা করি। মা আমাকে আদর করতে চায়, আমাকে বশ করতে চায়।
মা বলে, তুই আমার পেটে খুব লাথি মারতি, তোর লাথি আমার ভালো লাগতো।
আমি বলি, তখনও তুমি এমন কুৎসিত হয়েছিলে?
মা বলে, সবাই বলত আমি সুন্দর হয়েছিলাম।
আমার একটু ভালো লাগে; আমি বলি, তোমার পেটে আমি কীভাবে এসেছিলাম?
মা বলে, তোর বাবা জানে।
বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারবো না, আমি তখনই বুঝতে পারি; বাবা আমাকে কখনো কোনো গল্প বলেন নি। কোনো পাখি আর পরী আনে নি আমাকে? আমি মার পেটে হয়েছিলাম? আমার খুব সুখ লেগেছিলো যখন মা বলেছিলো একটি পাখি আর পরী জ্যোৎস্নারাতে মার কোলে রেখে গিয়েছিলো আমাকে;–মা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলো একটি ফুলের, লাল রঙের ফুল, তার অনেক সুগন্ধ; আর জেগে দেখে মার কোলে আমি ফুটে আছি। মা খুশিতে ভরে গিয়েছিলো, আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো আমি পাখি আর পরীর উপহার, আমি আকাশে উড়তে পারবো; আকাশ থেকে আকাশে উড়ে যেতে পারবো, আমার শরীরে সব সময় জ্যোৎস্না থাকবে, আমি মেঘের ওপর দিয়ে ঝড়ের ভেতর দিয়ে উড়ে যেতে পারবো। অনেক দিন আমি পাখি আর পরীর সাথে আকাশে আর মেঘে উড়েছি, ঝড়ে ছুটে চলেছি, জ্যোৎস্নায় ভেসে গেছি। কিন্তু মার নতুন কথা শুনে আমি অন্ধকার দেখতে থাকি; আমি পাখি আর পরীর কেউ নই, আমি অন্ধকারের মার পেটে কোনো আলো আর আকাশ আর ঝড় থাকতে পারে না, সেখানে অন্ধকার আছে বলেই মনে হয় আমার; ওই অন্ধকার থেকে আমি এসেছি। আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে। আমার মনে হয় সব কিছু অন্ধকারে গঠিত।
মা এক বিকেলে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চায়; আমার ইচ্ছে করে না। আমি মাকে বলি বিকেলে বেড়াতে যেতে আমার ভালো লাগে না, আমার খেলতে ইচ্ছে করে, খেলতে আমার ভালো লাগে। মা একলাই বেড়াতে যায়, আমি মাকে দূর থেকে দেখি; মা রিকশায় বসতে পারছে না, পড়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে আমি মাকে ধরি, যাতে মা পড়ে না যায়, কিন্তু আমি ছুটে যেতে পারি না। ওই বিকেলে আমার আর মাঠে যেতে ইচ্ছে করে না, আমি একা বারান্দায় বসে থাকি, বিকেলটা অন্ধকারের মতো আমার ওপর নামতে থাকে। আমার দুটি বন্ধু আমাকে খুঁজতে আসে, ওরা দরোজায় অনেকক্ষণ নাম ধরে ডাকে, আমি সাড়া দিই না। মা, তুমি ঠিকমতো রিকশায় বসতে পারছো তো, আমি মনে মনে বলি; তোমার সাথে বেড়াতে যেতে আমার ইচ্ছে করে না; কিন্তু আমি খেলতে যেতেও পারছি না, খেলতে গেলে সুখে, আমার বুক ভরে উঠবে, সেই সুখ আমার ভালো লাগবে না; তোমাকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু তোমাকে আমার কুৎসিত লাগে, তাই তোমার সাথে আমি যাই নি; নইলে খেলার থেকে তোমার সাথে বেড়াতে যেতেই আমার ভালো লাগে। মার ফিরে আসা পর্যন্ত আমি বারান্দায় বসে থাকি, সন্ধ্যে হয়ে গেলেও পড়ার টেবিলে যাই না, একটা রিকশার ছায়া দেখার জন্যে আমি সন্ত্রস্ত হয়ে থাকি; আর রিকশার ছায়া দেখার সাথে সাথেই পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি।