আমি একটি স্বপ্ন দেখি, অনেকটা দুঃস্বপ্নই; তবে দেখে চিৎকার করে ডলিকে আমি জড়িয়ে ধরি নি। কে যেনো আমার হাতে একটি লাল বেলুন এনে দিয়েছে, সেটি ফোলাচ্ছি আমি, খুব আনন্দ পাচ্ছি; ফুঁ দিচ্ছি, আমার মুখ থেকে বাতাসের থেকে লালা বেশি ঢুকছে বেলুনে, আমি যতোই বাতাস ঢোকাতে চাচ্ছি ততোই লালায় ভরে উঠছে বেলুন; ফুলতে ফুলতে একটা কুমড়োর মতো হয়ে উঠছে, খুব ভারী হয়ে উঠছে। আমি ফুঁ দিতেই থাকি, বেলুনটি লালায় ভরে উঠতে থাকে, আমি উড়োতে চাই, বেলুনটি ওড়ে না; এলিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বেলুনটি একটা উড়োজাহাজের সমান হয়ে উঠেছে, লালাভর্তি উড়োজাহাজ; শক্ত রশি দিয়ে আমি বেলুনটির গলা বেঁধে ফেলি। বেঁধে ফেলার পরই আমি লাখ লাখ কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পাই। খুব সরু আর মসৃণ চিৎকার; উল্লাসের না আতঙ্কের প্রথমে আমি বুঝতে পারি না। একেকবার আমার কাছে উল্লাস মনে হয়, একেকবার মনে হয় আর্তনাদ। ওই চিল্কারে আমার কান ভরে ওঠে, খোঁচা দিয়ে আমি বেলুন ফাটিয়ে দিই; আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপরও আমি উল্লাস আর আতঙ্কের কোলাহল শুনতে পাই; মনে হয় লালার স্রোতের নিচে আমি তলিয়ে যাচ্ছি, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু আমি চিৎকার করে উঠি নি, ডলি বুঝতেও পারে নি যে আমি একটি স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি।
কয়েক দিন পর ডলি তার একরাশ স্বপ্নের কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমি আমার পুরোনো-হয়ে-যাওয়া দুঃস্বপ্নটি বলি; শুনে ডলি খুশি হয়।
ডলি বলে, ওগুলো হচ্ছে আমাদের শিশুদের চিৎকার।
আমি বলি, তুমি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে পারো?
ডলি বলে, এটা খুব সহজ স্বপ্ন–তোমার রাবারে আটকে পড়ে আমাদের শিশুরা চিৎকার করছে; তুমি রাবারগুলো ফেলে দাও।
আমি বলি, তারপর কী করব?
ডলি বলে, আমাকে শিশু দাও।
আমি বলি, ভাবতেও আমার ভালো লাগে না।
ডলি বলে, তুমি বুঝতে পারছে না তোমার মন তোমাকে বলছে শিশুদের মেরো না?
আমি বলি, লাখ লাখ শিশু তুমি পেটে নিতে পারবে?
ডলি বলে, লাখ লাখ কেনো? একটি দুটো।
আমি বলি, আমি তো লাখ লাখ শিশুর চিৎকার শুনেছি।
ডলি বলে, আমি একটি দুটো শিশু চাই।
আমি বলি, চলো, কাল কোনো অনাথ আশ্রমে যাই।
ডলি বলে, অনাথ আশ্রমে কেনো?
আমি বলি, একটি শিশু আমরা অ্যাডোপ্ট করবো।
ডলি চিৎকার করে, না, না, না।
আমি বলি, তুমি তো শিশু ভালোবাসো, ওরাও শিশু।
ডলি বলে, আমি আমার শিশু চাই, আমার শিশুকে ভালোবাসতে চাই।
আমি বলি, মনে করো তুমি বন্ধ্যা।
ডলি ভয় পায়, চিৎকার করে, না, না, আমি বন্ধ্যা নই।
আমি বলি, মনে করো আমি বন্ধ্যা।
ডলি চমকে ওঠে, আমার দিকে কঠোরভাবে তাকায়, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ডলিকে কি আমি গর্ভবতী করবো? অন্তত একবার উদ্যোগ নেবো? ফেলে দেবো। প্রতিরোধকগুলো মানুষের বিরুদ্ধে আমি কাজ করে চলছি? অমানবিক আমি? আমার দায়িত্ব কিছু মানুষ জন্ম দিয়ে যাওয়া? পিতা-পিতামহদের মতো মানবিক হওয়া? গর্ভবতী করবো ডলিকে। কিন্তু গর্ভবতী নারী দেখতে আমার ভালো লাগে না, কখনো ভালো লাগে নি; মাকে গর্ভবতী দেখেই আমার ভালো লাগে নি। সিক্সে পড়ার সময় শুনতে পাই মার বাচ্চা হবে, শুনেই আমার ঘেন্না লাগে। কেউ আমাকে সংবাদটি দেয় নি, তবে সকলের মুখ থেকে আমি সংবাদটি পেয়ে যাই; একদিন আমার ইস্কুল থেকে ফিরতে ইচ্ছে হয় না, মনে হয় ইস্কুলের কোনো ঘরে লুকিয়ে থাকি। লুকোনোর জন্যে একটি ঘরে গিয়ে ঢুকি আমি, বুড়ো দপ্তরি আমাকে দেখে মনে করে আমি হয়তো কিছু হারিয়ে ফেলেছি। সে আমার কাছে এসে জানতে চায় আমি কী হারিয়েছি, কী খুঁজছি; আমি তাকে কিছু বলি না, বেঞ্চের নিচে সে আমার পেন্সিল বা কলম বা অন্য কিছু খুঁজতে শুরু করে। তার খোঁজা দেখে আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আমি বলতে পারি না। আমার কিছু হারায় নি, আমি লুকিয়ে থাকার জন্যে এ-ঘরে ঢুকেছিলাম। আমি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, দপ্তরি বলতে থাকে পেলে সে পরদিন আমাকে জিনিশটি ক্লাশে গিয়ে দিয়ে আসবে। আমি মনে মনে বলি, দপ্তরি, আমার হারানো জিনিশ তুমি কোনোদিন খুঁজে পাবে না। আমি কী হারিয়েছিলাম? মাকে অপবিত্র মনে হচ্ছিলো। আমার আমি হারিয়ে ছেলেছিলাম মার পবিত্রতা? কিছুদিন পর দেখতে পাই মা আর ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না; কলসি থেকে পানিও ঢেলে খেতে পারছে না। মার সামনের নিচের দিকটি খুব ফুলে উঠেছে, চোখ দুটি ব’সে গেছে; হাঁটার সময় মা এমনভাবে চলছে যেনো গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটছে। আমি দূর থেকে মার পা ফেলা দেখে মার জন্যে দুঃখ পেতাম; মা যেনো একবার তার সম্পূর্ণ একটি পা তুলে বিশ্রাম নিচ্ছে, তারপর পা ফেলছে; আবার বিশ্রাম নিয়ে আরেকটি সম্পূর্ণ পা তুলছে, তুলে বিশ্রাম নিচ্ছে, তারপর পাটি ফেলছে। বাবাকে তখন বাড়িতে দেখতেই পেতাম না; তাঁর কাজ অনেক বেড়ে গিয়েছিলো তখন, অনেক রাতে তিনি বাড়ি ফিরতেন। বাড়িতে থাকতাম আমি আর মা। মাকে আমি দূর থেকে সারাক্ষণ দেখতাম। মা কলসি থেকে পানি ঢেলেও খেতে পারতো না; তাই আমাকে ডাকতো। পানি ঢেলে দিতে আমার ইচ্ছে করতো না, কিন্তু দৌড়ে গিয়ে আমি পানি ঢেলে দিতাম; মা আমার দৌড়ে আসা দেখে খুব সুখ পেতা; আমার বলতে ইচ্ছে করতো, পানি ঢেলে দিতে আসতে আমার ইচ্ছে করে না; তবে আমি বলতে পারতাম না। মা খুব শব্দ করে পানি খেতো, শব্দ শুনে আমার ঘেন্না লাগতো–আগে তো মা শব্দ করে পানি খেতো না; আবার আরেক গেলাশ পানি চাইতো, তার পানি খাওয়ার ঢকঢক শব্দ শুনে আমার শরীরে পিচ্ছিল শ্যাওলা ঘন হয়ে উঠতো।