ডলিকে আজ আমি বাঁচিয়েছি, বলতে পারি, যেমন অনেকেই বলছে। লোকজন ভিড় করে প্রশংসা করছে, আমি কে জানতে চাচ্ছে; কেউ কেউ ডলির দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে, বুঝতে পারছি তারা এমন একটি নারীকে বাঁচাতে পারলে ধন্য বোধ করতে। আমি কি ধন্য বোধ করছি? ডলির সুন্দর শরীরের দিকে তাকিয়ে তাদের চোখ ঝলমল করছে, আমাকে হয়তো ঈর্ষাও করছে। আমি ধন্য বোধ করছি না, অর্থাৎ ধন্য বোধ করার মতো কিছু বোধ করছি না; ডলি সমুদ্রে ভেসে গেলেও আমি কষ্ট বোধ করতাম না–এটা নিশ্চিতভাবে আমি বলতে পারছি না, আমার এখন এমনই মনে হচ্ছে। কেনো বাঁচালাম তাহলে? ডলি তো বাঁচার জন্যে আমার কাছে প্রার্থনা করে নি। আমি কি তখন দেলোয়ারকে দেখতে পাচ্ছিলাম? আমার কি মনে হচ্ছিলো দেলোয়ার ডলিকে সমুদ্রে ভেসে যেতে দিতো না? দেলোয়ার নিজে ভেসে যেতে, ডলিকে ভেসে যেতে দিতো না? সমুদ্রকে আমার দেলোয়ার মনে হচ্ছিলো? দেলোয়ার সদ্র হয়ে ডলিকে কেড়ে নিচ্ছে আমার থেকে; আমি যে ডলির সাথে আছি, ডলি যে আমার সাথে আছে, ডলি যে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমরা যে মিলিত হই, দেলোয়ার তা সহ্য করতে পারছে না, এটা কি আমার মনে হচ্ছিলো? না কি আমি ভয় পাচ্ছিলাম সবাই আমাকে অপরাধী মনে করবে? মনে করবে আমি ইচ্ছে করেই ডলিকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছি। অপরাধীর মতো আমি ঢাকা ফিরে যেতে পারবো না? ডলিকে কি আমি বাঁচিয়েছি নিজেকে। বাঁচানোর জন্যে? ডলি সমুদ্রের দিকে ভেসে গেলে আমাকেও সাথে সাথে ভেসে যেতে হতো? আমার একা ফিরে আসা কেউ পছন্দ করতো না। আমি বাঁচতে চেয়েছি বলেই বাঁচিয়েছি ডলিকে? আমি সভ্য মানুষ, আমার দায়িত্ব প্রথম নারীকে বাঁচানো; সবার শেষে নিজেকে বাঁচানো, নিজেকে না বাঁচালেও চলে। আজ যদি আমি নিজে না বেঁচে ডলিকে বাঁচাতাম, তাহলে সভ্যতার পুস্তকে একটি নতুন অধ্যায় সংযোজিত হতো। সভ্যতার কথা আমার মনে ছিলো না, কেনো আমি তাহলে সমুদ্রের থাবা থেকে ডলিকে ফিরিয়ে আনলাম।
হোটেলে ফিরে ডলি বলে, আজ বুঝেছি তুমি আমাকে কতো ভালোবাসো।
আমি কোনো কথা বলি না।
ডলি বলে, আব্বাও হয়তো আমাকে এভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করতো না।
আমি বলি, বাঁচানো আর ভালোবাসার মধ্যে সম্পর্ক নেই।
ডলি বলে, অবশ্যই আছে; তুমিও আমার সাথে সমুদ্রে ভেসে যেতে পারতে।
আমি বলি, হ্যাঁ, পারতাম।
ডলি বলে, ভালো না বাসলে উদ্ধার করলে কেনো?
আমি বলি, উদ্ধারকারীরা ভালোবাসে বলে উদ্ধার করে না।
ডলি বলে, তুমি কি শুধুই আমার উদ্ধারকারী?
আমি কোনো কথা বলি না, ডলিও চুপ করে থাকে; আমার শরীর থেকে তার হাত দুটি খসে পড়ে। ডলির হাত দুটি আমার ধরতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ধরতে পারি না।
বছর দুয়েক কেটে গেছে; আমার মনেই পড়ে নি বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছু করার আছে। বেশ তো ভালোই বেঁচে আছি; ডলি দিন দিন আরো সুন্দর আর মাংসল হচ্ছে; সে পিল খাচ্ছে, আমি রাবার পরছি; আমি চেষ্টা করে চলছি যাতে ডলি কষ্ট না পায়, ডলি চেষ্টা করে চলছে যাতে আমি সুখ পাই। ডলির আশ্চর্য প্রতিভা আছে কষ্ট না পাওয়ার।
ডলি একদিন বলে, একটি কথা বলবো?
আমি বলি, বলো।
ডলি বলে, আমাদের কি একটিও ছেলেমেয়ে লাগবে না?
আমি বলি, ছেলেমেয়ের কথা আমার মনেই পড়ে নি।
ডলি বলে, মনে পড়ে নি তা ঠিক নয়।
আমি বলি, মানে?
ডলি বলে, তোমার খুবই মনে পড়ে।
আমি অবাক হই, বলি, আমার মনে পড়ে অথচ আমিই জানি না?
ডলি বলে, আমি বুঝি তোমার খুবই মনে পড়ে।
আমি বলি, কী করে বোঝো?
ডলি বলে, না-হওয়ার জন্যে তুমি যে-যত্ন নাও, তাতেই বুঝতে পারি।
আমি বলি, আমি কি না-হওয়ার জন্যে বেশি যত্ন নিই?
ডলি বলে, হ্যাঁ।
আমি বলি, তোমার ভালো লাগে না?
ডলি বলে, মাঝেমাঝে আমি কল্পনা করি তোমার রাবার ছিঁড়েফেড়ে গেছে, আমার পেটে একটা বাচ্চা এসেছে।
আমি বলি, পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে।
ডলি বলে, তাতে আমাদের কী? তারা আমার পেটের নয়।
আমি বলি, তোমার পেটে তো ও-রকম মানুষই হবে।
ডলি বলে, আমি আমার পেটের মানুষ চাই।
আমি বলি, ইচ্ছে করলে তুমি পেটে মানুষ নিতে পারো, দুটি, তিনটি, চারটি, পাঁচটি…।
ডলি চিৎকার করে ওঠে, তুমি কি আমাকে এমন ভেবেছো? অন্যের বাচ্চা আমি পেটে নেবো?
আমি বলি, অন্যের কেনো? তোমার।
ডলি বলে, আমি শুধু আমার বাচ্চা পেটে নিতে চাই না, তোমার বাচ্চা পেটে নিতে চাই।
আমি বলি, আমার বাচ্চা নেয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো মহিমা নেই।
ডলি বলে, আমি তোমরা বউ, তোমার বাচ্চাই তো আমি পেটে নেবো।
আমি বলি, হতে পারে জন্ম দেয়ার শক্তি আমার নেই।
ডলি বলে, খুবই আছে, তুমি ওই রাবারগুলো বিদেয় করো।
আমি বলি, আমি কোনো বাচ্চা চাই না।
ডলি বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ওঠে, তুমি মানুষ নও।
হয়তো আমি মানুষ নই; মানুষ হলে মানুষ জন্ম দিতে হয়; কিন্তু সত্যিই আমি বুঝে উঠতে পারি না মানুষ জন্ম দিয়ে কী সুখ? ধরা যাক আমি রাবারগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, ডলি পিলগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলো–অনেক আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, তারপর ডলিকে অনেক মাস প্যাড পরতে হলো না; মানুষ আসবে বলে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। ডলিকে আমি সপ্তাহে সপ্তাহে গাইনির কাছে নিয়ে যেতে থাকলাম, গাইনিটা তাকে দেখতে থাকলো, কী দেখলো আমি জানি না, ডলির জন্যে নানা ধরনের টেবলেট কিনলাম, পরীক্ষার পর পরীক্ষা করালাম; তাতে সুখ কোথায়? মানুষ জন্ম দিচ্ছি ভেবে আমি সুখ পেতে থাকবো? ডলি খুব ভয়ঙ্কর কল্পনা করতে পারে বলে মনে হচ্ছে; সে কল্পনা করছে রাবার ছিঁড়েফেড়ে যাচ্ছে; ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে আমার, সূর্যটা হঠাৎ ছুটে আসতে থাকলে যেমন লাগবে; আমাকে সাবধান হতে হবে, সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। সাবধান হতে হবে, লোহার থেকে শক্ত রাবার পরতে হবে। নারায়ণগঞ্জে তো আমি রাবার পরি নি, সেখানে কি আমি কোনো মানুষ সৃষ্টি করে এসেছিলাম? যদি সৃষ্টি করে এসে থাকি? সে-মানুষটা আমার নয়? সেটা এখন কোনো ড্রেনের পাশে ভিক্ষে করছে? যদি মেয়ে হয়? তার মায়ের পেশা শিখছে? না, ডলির পেটে আমি কোনো মানুষ সৃষ্টি করতে চাই না। কারো পেটেই আমি মানুষ সৃষ্টি করতে চাই না। মানুষকে আমি কি ঘেন্না করি? কখনো ভেবে দেখি নি। মানুষ প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখার একটা দায়িত্ব আছে আমার রক্তে আমি তেমন কোনো সংকেত পাই নি। ডলি হয়তো পাচ্ছে। প্রকৃতি আর সভ্যতা হয়তো তার রক্তে বেজে চলছে; তাকে নির্দেশ দিয়ে চলছে মানুষ বানানোর। তার ভেতরে মানুষ তৈরি হচ্ছে না বলে সে নিজেকে ব্যর্থ মনে করছে? সে সফল হতে পারে ভেতরে একটির পর একটি মানুষ সৃষ্টি করে? সভ্যতাকে দেখিয়ে দিতে পারে সে পাথর নয়, মরুভূমি নয়, নারী; তার ভেতরে উর্বর পলি রয়েছে; বীজ বুনলেই সেখানে সোনালি ধানের উৎসব শুরু হয়? পলিমাটিতে বীজ বুনবো আমি? আমার ইচ্ছে করে না। মানুষ তৈরি করার কথা ভেবে আমি কোনো সুখ পাই না।