গাড়িগুলো ফেরিতে উঠছে যেনো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে; অসংখ্য লেমিং ছুটছে কে কার আগে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে; বা শিশুরা ছুটছে কোনো মজার পুরস্কার পাবে বলে। দেলোয়ার গাড়ি নিয়ে সবার আগে ফেরিতে উঠে গেছে; ডলি আর আমি পিছিয়ে পড়েছি; একটা ট্রাকের জন্যে তার গাড়িটা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা দ্রুত ফেরির একপাশ দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি; আমি একবার দেলোয়ারের গাড়িটা দেখি; কিন্তু পরমুহূর্তেই তার গাড়িটা আর দেখতে পাই না। ফেরির সামনের দিকের লোকগুলো একবার খুব জোরে চিৎকার করে ওঠে; এবং একটা ট্রাক ভয়ঙ্কর শব্দ করে ব্রেক কষে। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য নদী দেখি; ডলি আমার দিকে অন্ধ হয়ে তাকায়।
আমি যে খুব জোরে চিৎকার করে উঠতে পারি না, তাতে আমার বিস্ময় লাগে না; কিন্তু ডলিও যে চিৎকার করে ওঠে না, তাতে আমি অপরাধ বোধ করতে থাকি। ডলির খুব জোরে চিৎকার করে ওঠা উচিত–আমার মনে হতে থাকে; তার নদীতে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করা উচিত-আমার মনে হতে থাকে; কিন্তু সে তা কিছুই করে না। তাতে আমার ভেতরে বেশি করে অপরাধবোধ জমতে থাকে। কেউ কেউ দেলোয়ারের গাড়ির জন্যে, দেলোয়ারের জন্যে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; তবে ওসব পণ্ডশ্রম;–দেলোয়ার যদি নিজে না উঠে আসে, তাহলে কেউ দেলোয়ারকে উঠিয়ে আনতে পারবে না; যখন পারবে তখন দেলোয়ার আর দেলোয়ার থাকবে না। লোকজন ঘিরে ধরেছে আমাদের, যে নদীতে পড়ে গেছে তার সাথে আমার কী সম্পর্ক, বিশেষ করে ডলির কী সম্পর্ক জানার জন্যে ব্যগ্র হয়ে পড়েছে; কিন্তু আমরা কিছু বলছি না, বলতে পারছি না। কয়েকটি দারোগাপুলিশ এসে পড়েছে; বড়ো দারোগাটি আমাদের সম্পর্ক না জেনে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না মনে হচ্ছে। সমস্ত সম্পর্ক জানার পরই সে ঠিক করতে পারবে দেলোয়ারের গাড়ি পানির ভেতর থেকে কীভাবে উদ্ধার করা হবে, বা উদ্ধার করা হবে কি না। আমি তাকে জানাই গাড়ি নিয়ে যে ডুবে গেছে, সে আমার বন্ধু; তার নাম মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; আর যে-মহিলাটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সে দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী; তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। দারোগা আর চারপাশের লোকগুলো আমার আর ডলির দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তাদের অদ্ভুত চোখ দেখে আমার মনে হয় আমার গাড়ির ভেতরে থাকা উচিত ছিলো; গাড়ির সাথে তলিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো; এমন মনে হওয়ার সাথে সাথে আমার ভেতরে অপরাধবোধটি আরো ঘন হয়ে উঠতে থাকে। গাড়ির ভেতরে ওই মাংসমেশানো গন্ধ যদি না পেতাম, আর পানি দেখে আমার যদি ভয় না লাগতো, অর্থাৎ আমি যদি সম্পূর্ণ সুস্থ হতাম ওই বাসের ভেতরে বসে থাকা লোকগুলোর মতো, এবং সাহসী হতাম, তাহলে এখন এই বড়ো দারোগা আর পাঁচটি পুলিশ আর চারপাশের লোকগুলো আমাদের দিকে এমন অদ্ভুতভাবে তাকাতে পারতো না। আমি না হয় গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলাম, কিন্তু ডলি নামলো কেনো? তার তো থাকার কথা ছিলো দেলোয়ারের সাথে। মাংসল কোনো গন্ধ নিশ্চয়ই তার নিশ্বাস বন্ধ করে নি; তবে সেও কি আমার মতো কোনো ভয়ে পীড়িত বোধ করেছিলো? তাহলে সে কি দেলোয়ারকে সম্পূর্ণ ভালোবাসে না? সে কি পানি দেখে ভয় পেয়েছিলো?–কেনো ভয় পাবে? লোহার সিন্দুকে ভরে তাকে কেউ পানিতে ফেলে দিয়েছে, এমন শ্বাসরুদ্ধকর বোধ তার হয়েছিলো?–কেনো স্বাসরুদ্ধকর বোধ হবে? সে কি সিন্দুকে দেলোয়ারকে দেখতে পায় নি? দেলোয়ার যদি সে-সিন্দুকে থাকে, তার শ্বাস কেনো আটকে আসবে? সে কি দেলোয়ারকে সম্পূর্ণ ভালোবাসে না? স্ত্রী হওয়ার সাথে সাথেই কি ভেতর থেকে ভালোবাসা জন্ম নেয় না? তাদের শরীর যেমন মিলিত হয়েছে, আমি ধরে নিচ্ছি, এক শরীর থেকে মধু যেমন ঢুকেছে আরেক শরীরে, তেমনভাবে এক শরীর থেকে আরেক শরীরে কি তাদের আত্মা আর প্রেম ঢোকে নি? ডলির বাইরে বেরিয়ে পড়াটা আমি সমর্থন করতে পারি না; এবং চারপাশে তাকিয়ে দেখি চারপাশের চোখ আমাদের, ডলির এবং আমার, বাইরে বেরোনো সমর্থন করতে পারছে না।
বড়ো দারোগা আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি বাইরে বেরিয়েছিলেন কেনো?
প্রশ্ন শোনার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারি আমি অপরাধ করেছি। দারোগারা শুধু প্রশ্ন করে না; তাদের প্রশ্নের ভেতরে অপরাধীর অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত থাকে; আমি বড়ো দারোগার প্রশ্নের মধ্যে ওই নিশ্চিত সিদ্ধান্তটি শুনতে পাই। আমার মনে হয় আমি অপরাধ করেছি কি না তা আমি ভালোভাবে বুঝতে পারছি না; বুঝতে পারছে বড়ো দারোগা; তার পোশাক, গোঁফ, হাতের লাঠি জানিয়ে দিচ্ছে অপরের ব্যাপার, বিশেষ করে অপরাধের ব্যাপার, বোঝার অধিকার তার ওপর অর্পণ করা হয়েছে। আমি অপরাধ করেছি কি না তা বোঝার শক্তি বা অধিকার আমার নেই, তা বুঝতে পারে ওই বড়ো দারোগা; এবং তার কথা শুনে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি আমি অপরাধ করেছি।
আমি বলি, গাড়ির ভেতরে সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
আমার কথা শুনে চারপাশ ডলির দিকে তাকায়, এবং ডলি তাকায় আমার দিকে।
দারোগা বলে, সুগন্ধে কারো দম বন্ধ হয়ে আসে না।
আমিও বড়ো দারোগাকে সমর্থন করি; আর কেউ যদি আমাকে বলতো সুগন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসে, তাহলে আমিও বলতাম সুগন্ধে কারো দম বন্ধ হয়ে আসে না। কিন্তু সত্যিই সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো; বিশেষ করে মাংসমেশানো সুগন্ধে; এবং আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাতে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে।