ডলি কখনো কখনো বলে, তুমি কিছু ভাবছো?
আমি বলি, না তো।
ডলি বলে, আমার মনে হচ্ছে ভাবছো।
আমি বলি, কী ভাবছি সেটাও তুমি বলো।
ডলি বলে, অতোটা পারবো না।
আমি বলি, তোমার কি সব সময় আমার মনের কথা জানতে ইচ্ছে করে?
ডলি বলে, আমার মনের কথা জানতে তোমার ইচ্ছে করে না?
আমি বলি, না তো।
ডলি বলে, অ।
আমি বলি, যদি বলতাম ‘হ্যাঁ’ তাহলে কি তুমি সুখী হতে?
ডলি বলে, মিথ্যে শুনে কেউ সুখী হয় না।
আমি বলি, আমি যতো সুখ পেয়েছি তার অধিকাংশই মিথ্যে থেকে।
ডলি বলে, তুমি কি এখন সুখ পাচ্ছো না? আমার জড়িয়ে ধরা, আমার ভালোবাসা কি মিথ্যে?
আমি বলি, সুখ পাচ্ছি কি না বুঝতে পারছি না।
ডলি বলে, তার মানে তুমি সুখ পাচ্ছো না।
আমি বলি, পাচ্ছি কি না বুঝতে পারছি না।
ডলি বলে, কেনো বুঝতে পারছো না? তোমার শরীর নেই, মন নেই?
আমি বলি, তুমি কি সুখ পাচ্ছো?
ডলি বলে, হ্যাঁ, পাচ্ছি।
আমি বলি, যদি বলি আমি তোমাকে মিথ্যে জড়িয়ে ধরে আছি?
ডলি কোনো কথা বলে না।
একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা-ডলি আর আমি। ডলিই প্রস্তাব দিয়েছিলো; আমার যদিও বেড়ানোর কোনোই আগ্রহ নেই, সিন্ধু বা শিশিরবিন্দু দেখার কোনোই ব্যাকুলতা কখনোই আমি বোধ করি নি–এজন্যেও আমার একটা গোপন অপরাধবোধ রয়েছে,–আমি রাজি হয়েছিলাম। ডলি সমুদ্র দেখতে চেয়েছিলো, আমিও তার সাথে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। আমার কাছে সমুদ্র দেখাটা দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিলো ডলি কি আগে সমুদ্র দেখেছিলো? আমি জানতে চাই নি; মনে হয়েছিলো ডলি সমুদ্র দেখেছে, আর আমি যদি তাকে অন্তত একবার সমুদ্র না দেখাই, সে চিরকাল একটা দীর্ঘশ্বাস পুষবে। ডলির কাছে আমি কৃতজ্ঞ, ডলি আমাকে সমুদ্র দেখিয়েছিলো, নইলে আমার সমুদ্র দেখা হতো না। সমুদ্র দেখে, আমি মনে করেছিলাম, আমি খুব বিচলিত চঞ্চল হয়ে উঠবো, কিন্তু আমি ততোখানি চঞ্চল বিচলিত হচ্ছিলাম না; আমাদের চারপাশে যারা খুব চঞ্চল হয়ে পড়ছিলো, যতোটা চঞ্চল হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব তার চেয়ে বেশি চঞ্চল হওয়ার চেষ্টা করছিলো, তারা সদ্ৰপারের নুড়ি আর কাকড়া হ’তে চাচ্ছিলো; আমার মনে হচ্ছিলো নুড়ি আর কাকড়া তারা কখনো হতে পারবে না। ডলি আমাকে জড়িয়ে ধরে নোনাজলে গড়িয়ে পড়ছিলো, ডলির চঞ্চলতায় বিব্রত বোধ করছিলাম আমি। ডলির মতো গড়িয়ে পড়তে পারছিলাম না বলে ডলি আমাকে ভীতু মনে করছিলো; ভীতু মনে করে সুখ পাচ্ছিলো।
ডলি বলছিলো, তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেনো?
আমি বলছিলাম, একটুও ভয় পাচ্ছি না।
ডলি বলছিলো, চলো আরো সমুদ্রের দিকে যাই।
আমি বলছিলাম, কতো দূরে তুমি যেতে চাও?
ডলি বলছিলো, যতো দূরে তুমি আমাকে নিতে চাও।
আমি বলছিলাম, আমি এখানেই থাকতে চাই।
ডলি বলছিলো, কেনো?
আমি বলছিলাম, ভয়ঙ্কর কোনো ঢেউ আসতে পারে।
ডলি বলছিলো, আসুক।
আমি বলছিলাম, দেলোয়ারকে জড়িয়ে ধরে তুমি কি আরো সমুদ্রের দিকে গিয়েছিলে?
ডলি বলছিলো, আহ্, আবার দেলোয়ার।
আমি বলছিলাম, তুমি কি কিছু মনে রাখো না?
ডলি বলে, রাখি, যা মনে রাখার।
ডলি আমাকে জড়িয়ে ধরে নোনাজলে গড়িয়ে পড়ে, নিজেকে আমার দেলোয়ার মনে হয়। কোনো দিন কি আমি ডলির বদলে অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরে এই নোনাজলে গড়িয়ে পড়বো? তখন আমার কী মনে পড়বে? আমার ভয় হতে থাকে একটা মারাত্মক ঢেউ এসে আমাকে গভীর সমুদ্রের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, আমি ডলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। ডলি খুব সুখী হয়ে ওঠে।
ডলি বলে, সমুদ্রের পানিতে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে কী যে সুখ লাগছে।
আমি বলি, শয্যার থেকেও বেশি? ডলি বলে, কী যে বলো।
ডলি খুব উল্লসিত, সে সমুদ্রের নুড়ি আর লাল কাকড়ায় পরিণত হয়ে গেছে তার উল্লাস দেখে আমার সুখ লাগছে, এবং মনে হচ্ছে ডলি একটু বেশি সুখী বোধ করার চেষ্টা করছে।
আমি বলি, ডলি, তুমি একটু বেশি সুখী বোধ করছো।
ডলি বলে, আমি তো বেশি সুখীই।
আমি বলি, আমার তা মনে হয় না।
ডলি বলে, তোমার কী মনে হয়?
আমি বলি, সমুদ্রের জলে তুমি কিছু একটা ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করছো।
ডলি বলে, তুমি আমাকে গভীর সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দাও।
আমি বলি, আমি কি এত নিষ্ঠুর?
ডলি বলে, তুমি যা বলছে তার চেয়ে সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দিলেও আমি কম কষ্ট পাব।
এমন সময় একটি ঢেউ আসে। ঢেউয়ের জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না, আর প্রস্তুত থাকার জন্যে ডলি সমুদ্রে আসে নি; তার হয়তো ধারণা সমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে তারই জন্যে, তারই গড়িয়ে পড়ার জন্যে; এমন কোনো ঢেউ আসতে পারে না, যা তাকে গভীর সমুদ্রে টেনে নিতে পারে। নোনাজলের আকস্মিক আক্রমণে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি, কিন্তু পা দুটি আমি মাটিতে অলৌকিকভাবে ঢুকিয়ে দিই, এবং ডলিও আমার ওপরে এসে পড়ে। ডলি আমাকে ধরার চেষ্টা করে, ধরে উঠতে পারে না; আমিই তার একটি হাত ধরে ফেলি। ডলির হাতটি আমি ছেড়ে দিতে পারতাম, ডলির হাত খসে যেতে পারতো আমার হাত থেকে তার কোনোটিই হয় নি। ঢেউটি আমাদের দুজনকেই প্লাবিত করে দেয়, এবং অল্পপরেই সমুদ্রের দিকে টানতে থাকে। আমি তখন আমার পা দুটি আরো শক্তভাবে মাটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছি, ডলিরও হাত দুটি শক্তভাবে ধরেছি। ডলি আমাকে ধরেছে বলে মনে হয় না; হয়তো তার ধরার কথাই মনে হয় নি ঢেউটি টান দেয়, আমার ইচ্ছে হয় ডলিকে ছেড়ে দিই, কিন্তু তখনই আমার ভেতরে অপরাধবোধটা জেগে ওঠে, আমার সাথে সেদিন বেবিতে না উঠলে ডলি আজ সমুদ্রে ভেসে যেতো না, সে শহরে থাকতো, আমি তার হাত দুটি শক্তভাবে ধরে রাখি; এমন শক্তভাবে কখনো কিছু আমার ধরতে হয় নি। ডলি কি সাঁতার জানে? নিশ্চয়ই জানে না। ডলির এখন কী মনে হচ্ছে তার কি সমুদ্রে ভেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে? ডলি আমার হাত ধরে নেই, আমিই ধরে আছি ডলির হাত; মনে হচ্ছে সমুদ্রে ভেসে যেতে তার ভালোই লাগবে। কিন্তু আমি তাকে ভেসে যেতে দিতে পারি না। আমি সমুদ্রে একটি নারীকে নিয়ে নেমেছিলাম; জোয়ার আসার কথাও আমি জানতাম; সবাই তাদের নারীদের নিয়ে ওপরে উঠে গেছে, শুধু আমিই আমার নারীকে ঢেউয়ের হাতে তুলে দিয়ে উঠে আসবো? আমার খুব নিঃসঙ্গ লাগবে। আমি ডলির হাত ধরে থাকি। আমার পা বালুর ভেতর থেকে উঠে আসে; সাঁতার দিয়ে সমুদ্রকে আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে থাকি। ডলি আমাকে ধরে নেই, ধরার কথাও হয়তো তার মনে নেই; তাকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমার, সে হয়তো তাই মনে করছে, আমি তাকে ধরে রাখছি। ডলি, তোমাকে আমি ধরে আছি, যদি তুমি ছুটে যাও, মনে কোরো না আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি, আমি তোমাকে ছেড়ে দিই নি, আমার মনে হতে থাকে, পারলে তোমাকে আমি জড়িয়ে ধরে রাখতাম, চুমো খেতাম, সঙ্গম করতাম, আমার মনে হতে থাকে, তুমি সমুদ্রের না আমার জানি না, সমুদ্র তোমাকে নিয়ে গেলেও তুমি মনে কোরো না আমি তোমাকে সমুদ্রের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। ঢেউটি কেটে যায়, আমি ডলিকে জড়িয়ে ধরে পারে এসে এলিয়ে পড়ি।