ডলিকে খুব সুখী করতে হবে-ডলির মুখটি বারবার মনে করতে না পেরে এবং পুনরায় মনে করার চেষ্টা করতে করতে একথা আমার মনে হয়; ভয়ঙ্কর সুখী করতে হবে, অশেষ সুখী করতে হবে, এতো সুখী যা ডলি সহ্য করতে পারবে না; আমি মানুষ, মানুষের কাজ মানুষকে সুখী করা; ডলি মানুষ, ডলি আমার নিজস্বতম মানুষ; তাকে সুখী করতে হবে; কখনো যেনো সে কষ্ট না পায়, কখনো বুঝতে না পারে আমি একটা অপরাধবোধের মধ্যে রয়েছি, ডলি অনুভব করতে না পারে প্রেতের সাথে আমি যুদ্ধ করে চলছি। আমাকে কি দেলোয়ারের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হবে, যতদিন আমি বাঁচবো, ডলি বাঁচবে? বেঁচে থেকে সুখ পাবো? আমার অপরাধবোধ উত্তরাধিকারীর রক্তে সংক্রামিত করে যাবো? কোনো উত্তরাধিকারে আমি বিশ্বাস করি না, কোনো উত্তরাধিকারী চাই না; আমি কোনো অপরাধীকে রেখে যেতে চাই না। ডলি কি মেনে নেবে? একটি দুটি উত্তরাধিকারীর জন্যে ডলি পাগল হয়ে উঠবে না? তার ভেতর কি একটা মারাত্মক মা জেগে উঠবে না? আমি কোনো পুত্র চাই না, কন্যা চাই না; পুত্রকন্যাকে জড়িয়ে ধরতে চাই না। পাশের বাসায় একটি নতুন পুত্র জন্মেছে বোধ হয়, ওর চিৎকার আমার কানে লাগে; কর্কশ মনে হয়। আমি কখনো কোনো শিশু কোলে নিই নি; আমি কোনো উত্তরাধিকারী রেখে যাবো না। ডলিকে সুখী করতে হবে। কীভাবে সুখী করতে হয়? ডলি কিসে সুখী হবে? ডলি এখন কী ভাবছে? ডলি কি আমাকে সুখী করার কথা ভাবছে? আমরা কেউ কি সুখী করতে পারি কাউকে? আমি ডলিকে, ডলি আমাকে? আমি যে এতোদিন বেঁচে আছি, এটা কি সুখ? সুখ কি মানুষের জন্যে দরকার? দেলোয়ার কি সুখে ছিলো, ডলি কি দেলোয়ারকে সুখী করেছিলো? দেলোয়ার ডলিকে? আমার বাবা মা কি সুখী? ডলির বাবা মা? মানুষ কি কখনো সুখী হয়েছে। কিন্তু ডলিকে সুখী করতে হবে। ডলি সুখী না হলে মনে হবে দেলোয়ার নিশ্চয়ই সুখী করতে পারতো ডলিকে; আমি পারছি না।
ভোরবেলা ডলির দিকে আমি চায়ের পেয়ালাটি এগিয়ে দিই।
ডলি অনেকটা চিৎকার করে ওঠে, করছো কী, করছে কী? আমি তোমাকে চা করে দিচ্ছি।
আমি বলি, দেখো তো চিনি ঠিক হয়েছে কি না?
ডলি পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ঝলমল করে ওঠে, তুমি এতো চমৎকার চা বানাতে পারো।
ডলির কী যেনো মনে পড়ে; বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে এক পেয়ালা চা বানিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেয়।
আমি বলি, আমি তো নিজেই বানাতাম।
ডলি বলে, তুমি আমাকে চা বানিয়ে দেবে, নিজে বানিয়ে খাবে; শুনলে সবাই কী বলবে?
আমি বলি, সবার কী বলার ভয়েই তুমি চা বানালে?
ডলি উত্তর দেয় না; বরং নিজেই প্রশ্ন করে, আমার জন্যে তুমি কেনো চা বানালে, বলো তো?
আমি অপরাধীর মতো বলি, তোমাকে সুখী করতে চাই।
ডলি হাসে, কেনো সুখী করতে চাও?
আমি বলি, আমার অনেক অপরাধ।
ডলি বলে, তোমার কোনো অপরাধ নেই, অপরাধ আমার।
আমি বলি, না; তুমি অপরাধ করতে পারো না।
ডলি বলে, আমি চেয়েছিলাম দেলোয়ারের গাড়িটা পানিতে পড়ে যাক।
আমি বলি, আমাকে সুখী করার জন্যে তুমি এটা বানিয়ে বললে।
ডলি বলে, দেলোয়ারের গাড়ি পানিতে পড়লে তুমি কেনো সুখী হবে? বন্ধুর গাড়ি পানিতে পড়লে কেউ সুখী হয় না।
আমি বলি, হয়তো আমি হই।
ডলি বলে, আমার তা মনে হয় না।
আমি বলি, আমাকে কি সুখী মনে হচ্ছে না?
ডলি কোনো উত্তর দেয় না, আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, চা খাও।
ডলি বলে, চা খেতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বলি, কেনো?
ডলি বলে, জানি না।
আমি বলি, আমি বোধ হয় জানি।
ডলি চুপ করে থাকে; আমি চা খাই, সিগারেট ধরাই; চা আর সিগারেট দুটিই আমার ভালো লাগে।
আমি যে আগে খুব অনিয়মিত ছিলাম বাসায় ফেরার ব্যাপারে, এমন নয়; ঠিকঠাক সময়েই আমি বাসায় ফিরেছি এতোদিন, বেরিয়েছিও ঠিকঠাক সময়ে; কিন্তু এখন থেকে আমি আরো নিয়মিত হয়ে উঠতে থাকি। আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারি না কেনো সব কিছু আমি এতো ঠিকঠাকভাবে করছি। বেলা এ নিয়ে কয়েকবার পরিহাসও করে, আমি তাতে কান দিই না। আমিই বিস্মিত হই আমার নিখুঁত আচরণে, আমার অসম্ভব মানবিকতায়।
ডলি একদিন বলে, তুমি খুব চমৎকার।
আমি জানতে চাই, কেনো এমন মনে হচ্ছে?
ডলি বলে, তোমাকে নিয়ে একটুও চিন্তায় থাকতে হয় না; ঠিক সময়ে তুমি ফেরো, ঠিক সময়ে বাইরে যাও।
আমি বলি, মাঝেমাঝে তো আমার দেরি হয়।
ডলি বলে, দেরি হলেও তুমি টেলিফোনে জানিয়ে দাও।
আমি বলি, এখন থেকে দেরি করে ফিরবো, দেরি হলেও জানাবো না।
ডলি বলে, না, না; দেরি কোরো না, দেরি হলে জানাবেই।
বাসায় ফেরার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার কাছে; আমি বুঝতে চেষ্টা করি কেনো আমি এতো নিয়মিত দেলোয়ার কি সময় মতো ফিরতো। আমি জানি না। দেলোয়ারের ব্যবসা ছিলো; যারা ব্যবসা করে, তাদের একটি বড়ো স্বাধীনতা থাকে, ঠিক সময়ে তাদের ফিরতে হয় না; ঠিক সময়ে ফিরলেই সবাই মনে করে তাদের ব্যবসা জমছে না; দেরি করে বা মাঝরাতে বা কখনো কখনো না ফিরলে সবাই মনে করে তাদের ব্যবসা এতো জমছে যে বাসায় ফেরার মতো সময়ও তারা পাচ্ছে না; যখন তারা বাসায় ফেরে সবাই তাদের মুখের দিকে তাকায় যেনো তারা বীরের মুখ দেখছে। দেলোয়ার কি দেরি করে ফিরতো? মাঝেমাঝে ফিরতো না? ডলিকে জিজ্ঞেস করে দেখবো? জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হবে? আমি যা করি, তাতে দেরি করার সুযোগ খুব কম। আমার মনে হয় দেলোয়ার দেরি করে ফিরতো না; তার বাসায় ডলি ছিলো, বাসায় ডলি থাকলে দেলোয়ার দেরি করে ফিরতে পারে না। আমি কি ডলির জন্যে ঠিক সময়ে ফিরি? আমি ফিরলে ডলির মুখটি উজ্জ্বল দেখায়, ওই উজ্জ্বলতা আমার ভালো লাগে; কিন্তু আমি উজ্জ্বলতার জন্যে ফিরি না, ফিরি দেলোয়ারের জন্যে; দেলোয়ারের আগে আমাকে অবশ্যই বাসায় ফিরতে হবে। দেলোয়ার একশো মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছে, একটার পর একটা গাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে; রিকশা এড়িয়ে, ট্রাক–বাস বেবির জট পেরিয়ে, লালবাতির নিষেধ না মেনে ছুটে চলছে ডলির দিকে; আমাকে তারও আগে ডলির কাছে পৌঁছোত হবে। আমি কি ডলির জন্যে প্রবল আবেগ বোধ করি? ভাবতেও আমি ভয় পাই। যদি দেখতে পাই ডলির জন্যে আমি আবেগ বোধ করি না, আমি তা সহ্য করে উঠতে পারবো না হয়তো; দেলোয়ার নিশ্চয়ই প্রবল আবেগ বোধ করতো। আমার আবেগ দেলোয়ারের আবেগের থেকে কম হলে আমি খুব অপরাধ বোধ করতে থাকবো। আমি তাই আবেগের কথা ভাবি না, ডলির কথা ভাবি; ডলি আছে, তাই আমার ভেতরে নিশ্চয়ই আবেগ আছে ডলির জন্যে, আমি এমন ভাবতে চেষ্টা করি। একবার মনে হয় ডলির জন্যে সম্ভবত আমি কোনো আবেগ বোধ করি না; ডলিকে যদি আর কোনোদিন নাও দেখতে পাই তাহলেও আমার ভেতরে তার জন্যে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হবে না। মনে হবে না আমি কিছু হারিয়ে ফেলেছি। ডলি কখনো কখনো খুব আবেগকাতর হয়ে জড়িয়ে ধরতে পারে, তখন তার শরীর ঝরনার মতো বইতে থাকে; আমি ওই মুহূর্তে খুব আবেগ বোধ করার চেষ্টা করি, ডলির মতোই প্রবাহিত হতে চাই; কিন্তু পারি না। ডলি তা বুঝতে পারে না; পারে না বলে আমার ভালো লাগে; তারপরই আমার মনে একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে, আমার খারাপ লাগে যে ডলির জন্যে আমি আবেগ বোধ করছি না।