আমি বলি, এতো শব্দ যে কেনো হলো!
ডলি মধুরভাবে আমার দিকে তাকায়; তার চিবুক আবার আমার চোখে পড়ে। একটি বিশাল লাল গোলাপের মতো তার শরীর থেকে তীব্র সুগন্ধ এসে আমার রক্তের ভেতরে ঢোকে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে না।
আমি বলি, সেই তীব্র সুগন্ধটি পাচ্ছি।
ডলি বলে, তোমার কি দম বন্ধ হয়ে আসছে?
আমি বলি, না; আরো তীব্র.সুগন্ধ পেতে ইচ্ছে করছে।
ডলি বলে, তুমি এতো দূরে থাকলে কী করে তীব্র সুগন্ধ বেরোবো।
আমি ডলির কাছে গিয়ে বসি, এবং বলি, হাতটি ধরি?
ডলি বলে, শুধু হাত ধরবে?
আমি বিব্রত বোধ করি; ডলির বাঁ হাতটি প্রায় ধরে ফেলেছিলাম, আমার হাতটি কেঁপে কেঁপে সরে আসে।
ডলি বলে, আমার সারা শরীর তুমি ধরো।
ডলির সারা শরীরটি আমি একবার মনে মনে ধরি, আমার বাহু উপচে শাদা, দুগ্ধধারার মতো ডলির শরীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরটাকে আমি ধরতে পারি না; ডলির শাড়ির ভেতরে মুখ গুঁজে একবার নিশ্বাস নিই; তারপর আবার ডলির মুখের দিকে তাকাই।
আমি বলি, দেলোয়ারকে আমার মনে পড়ছে।
ডলি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, এ-নামের কাউকে আমি চিনি না।
আমি বলি, দেলোয়ার আমার বন্ধু ছিলো।
ডলি বলে, তোমার কোনো বন্ধুর গল্প আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বলি, কী গল্প তোমার শুনতে ইচ্ছে করে?
ডলি ঠোঁট দুটি বাড়িয়ে দিয়ে একটি আঙুল ঠোঁটের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত টানতে টানতে বলে, এ-দুটো সম্পর্কে তুমি গল্প বলো। আমার ভালো লাগবে, রাতভর শুনতে ইচ্ছে করবে।
আমি বলি, তোমার ছটি ঠোঁট রয়েছে।
ডলি হেসে ওঠে, আমি কি রাক্ষস যে ছটি ঠোঁট থাকবে?
আমি বলি, তুমি রাক্ষস নও, রাক্ষসদের কতোগুলো ঠোঁট থাকে আমি জানি না; কিন্তু তোমার তিন জোড়া ঠোঁট আছে-লাল, রঙিন, কোমল, গোলাপপাপড়ি।
ডলি হেসে ওঠে, হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে বলে, একটু পরই হয়তো বলবে আমার লাখ লাখ ঠোঁট আছে।
আমি বলি, তোমার এই ঠোঁট দুটিতে ময়লা লেগে ছিলো।
ডলি চমকে ওঠে, ময়লা? আমার ঠোঁটে?
আমি বলি, এখন নেই।
ডলি বলে, কখনো ছিলো না।
লাল রঙের ঠোঁটের অন্ধকার আমাকে গ্রাস করে। আমি অজস্র লাল লাল লাল লাল ঠোঁট দেখতে পাই; আমি লাখ লাখ লাল লাল দরোজা খুলে ঢুকতে থাকি, ঢুকে আরো লাল লাল অন্ধকার থেকে আরো লাল অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে, যেনো অজস্র জন্ম ধরে এগোচ্ছি, আমি আর এগোতে পারি না; মহাশূন্য থেকে খসে পড়ে যাই, পিছলে পড়ে যাই; চাঁদ তারা সূর্য আর যা কিছু আছে যা কিছু নেই আমি জড়িয়ে ধরে থাকতে চাই, আমি কিছুই জড়িয়ে ধরতে পারি না, ব্যর্থ হয়ে আমি পাতালে পড়ে যেতে থাকি, পাতাল এতো নিচুতে যে সেখানেও আমার পা ঠেকে না। মহাজগতে, আমার মনে হয়, ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নেই; এর আগে ব্যর্থতাকে আমি এমনভাবে অনুভব করি নি। ডলি আমাকে জড়িয়ে ধরে; আমি ঠেলে সরিয়ে দিই। নিজেকে আমার ক্লান্ত মনে হয় না, ব্যর্থ মনে হয়; দেলোয়ারকে মনে পড়ে, দেলোয়ার কখনো ব্যর্থ হতো না, দেলোয়ার নিশ্চয়ই সফল হয়েছিলো, এমন মনে হতে থাকে; আমার দেলোয়ার হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, গাড়ি নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তেও আমি ভয় পাই না। ডলি আমাকে আর জড়িয়ে ধরছে না; সে হয়তো এখন দেলোয়ারকে জড়িয়ে ধরে আছে; আমাকে আর ধরবে না। ডলিকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে আমার, আমি ছুঁতে পারছি না; ডলিকে ছুঁতে গেলে হয়তো অন্য কারো শরীরে আমার শরীরে ঠেকবে, অন্য কোনো হাত আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেবে; ডলির ওষ্ঠ হয়তো এখন অন্য কোনো ওষ্ঠের সাথে জড়িয়ে আছে গেঁথে আছে; আমি টানলেও ডলি ওই ওষ্ঠ থেকে নিজের ওষ্ঠকে উদ্ধার করতে পারবে না; আরো বেশি করে সমর্পণ করবে। ডলির মাংসে হয়তো ঢুকে আছে অন্য কোনো মাংস; সে-মাংস আমার নয়; ডলি সে-মাংস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইবে না হয়তো। এখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে উঠেছে, কোনো রঙ নেই; লাল রঙটি মুছে গেছে, মহাজগতে ডলি আছে কি না তাও আমি অনুভব করতে পারছি না।
আমি ডাকি, ডলি।
ডলি সাড়া দেয়, বলো।
আমি বলি, তুমি কি আমাকে ঘেন্না করছো?
ডলি বলে, ঘেন্না করবো কেনো?
আমি বলি, তুমি কি কষ্ট পাচ্ছো?
ডলি বলে, হ্যাঁ, একটা কেমন কষ্ট লাগছে।
আমি জানতে চাই, কষ্টটা কেমন?
ডলি বলে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো।
আমি বলি, আর ঘুম আসবে না মনে হচ্ছে?
ডলি বলে, হ্যাঁ।
আমি বলি, তোমার খুব ঘুম পাচ্ছিলো?
ডলি বলে, হ্যাঁ।
আমি বলি, তোমার কি মনে হচ্ছে ভুল করেছো?
ডলি বলে, কী ভুল?
আমি বলি, আমাকে বিয়ে করে?
ডলি বলে, আমি ওসব ভাবছি না।
আমি বলি, দেলোয়ার কি ব্যর্থ হয়েছিলো?
ডলি চুপ করে থাকে; আমি বলি, ডলি, দেলোয়ার কি ব্যর্থ হয়েছিলো?
ডলি বলে, না।
আমার ভেতরে অজস্র বজ্র আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ছুটতে থাকে; কিছুতে থামে না।
আমি বলি, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
ডলি বলে, না।
আমি বলি, কী করেছিলে?
ডলি বলে, আমাকে সে খুন করেছিলো।
আমি বলি, তুমি সুখী হয়েছিলে?
ডলি বলে, দশ পনেরো দিন আমি বসতে পারি নি, দাঁড়াতে পারি নি, ঘুমোতে পারি নি; আমার শরীরটা আমার ছিলো না।
আমি বলি, দেলোয়ার সব সময়ই সফল।
ডলি কোনো কথা বলে না।
ডলিকে ডাকতে আমার সাহস হয় না; আমরা যে পাশাপাশি শুয়ে আছি, ঠিক শুয়ে নয় ঠিক পাশাপাশি নয়-একই বিছানায় পড়ে আছি, একেও আমার অস্বাভাবিক মনে হয়; আমাদের এভাবে থাকার কথা ছিলো না। বিছানা থেকে উঠে টেবিলে গিয়ে বার ইচ্ছে হয়, অনেকগুলো সিগারেট খাওয়ার ক্ষুধা জাগে; আমি উঠতে পারি না, সিগারেট খেতে পারি না; আমার ভেতরটা মরুভূমি হয়ে ওঠে। ডলির থেকে সব কিছু আমার প্রিয় মনে হয়; সব কিছুর সাথেই আমার জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, শুধু ডলিকে ছাড়া। খুব দূরে খুব বড়ো বা খুব ছোটো কোনো গাছের নিচে বসে থাকার সাধ হয়, ডালে কোনো পাখি আছে কি না খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে; মনে হয় বছরের পর বছর ধরে আমি পাখি খুঁজতে পারি; কোনো ছোটো নদীতে একটা ছোটো নৌকোয় বসে নদী পার হ’তে আমার ভালো লাগে, ঢেউয়ের দোলাগুলো আমার রক্তে দুলতে থাকে; ট্রেন থেকে পুকুরে অনেকগুলো শিশুকে সাঁতার কাটতে দেখেছিলাম, তাদের মনে করে আমি সুখ পাই; নারায়ণগঞ্জে যে-মেয়েটি ব্লাউজ খোলে নি, তার মুখটিও মনে পড়ে, আমি সুখ পাই। সব কিছুর মুখ আমার মনে পড়ে, ডলির মুখ ছাড়া; তিন চারটি রিকশাঅলার মুখ মনে পড়ে, বাসা থেকে বেরোলেই কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাই, মুখগুলো মনে পড়ছে, ওদের মুখের দাগগুলো আর ঘাগুলোও দেখতে পাচ্ছি; ডলির মুখটি দেখতে পাচ্ছি না। একটি নদীর মুখ আমার মনে পড়ে। একবার আমি গিয়েছিলাম বনের পর বন পেরিয়ে, পাহাড় পেরিয়ে, উঁচুনিচু পথ পেরিয়ে ওই নদীর পারে গিয়েছিলাম; নীল দাগের মতো পড়ে আছে নদী, ছোটো ছোটো ঢেউ, নদীতে নৌকো নেই, জাহাজ নেই; শুধু নীল হয়ে পড়ে থাকাই কাজ ওই নদীর। নদী পেরিয়ে ওপাশে কেউ যায় না, ওপাশ থেকে এপাশে কেউ আসে না; নদী শুধু নীল হয়ে পড়ে থাকে। ডলির মুখটি আমার মনে পড়ে না। আমি চোখ ভরে বালুকার স্থূপ দেখতে পাই।