বাসায় ফিরতে আমার ঘণ্টাখানেকের মতে দেরি হয়; তিনটার মধ্যেই সাধারণত আমি ফিরি, আজ চারটে বেজে যায়।
ডলি জিজ্ঞেস করে, তুমি কি চারটেয়ই ফেরো?
আমি বলি, না।
ডলি বলে, তাহলে কটায় ফেরো?
আমি বলি, তিনটেয়।
ডলি বলে, আজ যে চারটেয় ফিরলে?
আমি বলি, আজ হেঁটে এলাম।
ডলি বলে, হেঁটে? হেঁটে কেনো?
আমি বলি, মনে হলো তোমার কাছে হেঁটে আসাই উচিত।
ডলি বলে, কেনো এমন মনে হলো?
আমি বলি, মনে হলো তীর্থে যাচ্ছি; চারদিকে পাহাড়, নদী, উঁচুনিচু পথ; মন্দির অনেক ওপরে, যদিও আমি তীর্থ মন্দির পবিত্রগৃহে বিশ্বাস করি না।
ডলি বলে, আমি তীর্থ নই, তুমি আর হেঁটে এসো না।
আমি বলি, কেনো?
ডলি বলে, তীর্থে মানুষ একবার যায়, গিয়ে কাউকে পায় না।
ডলির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় তার শরীরে কোনো দাগ নেই; কখনো দাগ ছিলো না।
ডলি বলে, আমি তীর্থ নই; আমি গৃহ, তোমার গৃহ, গৃহে থাকতে হয়, বারবার ফিরতে হয়; তীর্থ থেকেও মানুষকে গৃহে ফিরতে হয়। ডলি কথাগুলো বেশ হাল্কা করে বলছে; সে বুঝতে পারছে কথাগুলোর ওপর একটু জোর দিলেই কথাগুলোকে কোনো প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থের চরণ মনে হবে।
আমিও লঘু ভঙ্গিতে বলি, গৃহ যে আমার ভালো লাগে না।
আমার কথা শুনে ডলি একটু ভয় পায়; বলে, এতো দিন তোমার গৃহ ছিলো না, তাই তোমার গৃহ ভালো লাগতো না, এখন থেকে লাগবে।
আমি বলি, লাগছে না তো।
ডলি একটু দূরে গিয়ে চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে সে কী দেখছে আমি জানি না; হয়তো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, যদিও অনেক কিছু দেখতে চাচ্ছে, অন্তত একটি গৃহ দেখতে চাচ্ছে। আমি গিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত রাখি।
আমি বলি, ডলি, তোমাকে আমি খুব সুখী করতে চাই।
ডলি আমার হাতে হাত রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে।
বাড়িতে হঠাৎ উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ডলির আব্বাআম্মা ভাইবোনেরা শাড়ি অলঙ্কার অজস্র জিনিশপত্র নিয়ে এসেছে ডলির জন্যে, আমার জন্যেও কী সব এনেছে। আমি বিব্রত বোধ করি; আমি আমার ঘরটিতেই বসে থাকতে চাই, কিন্তু পারি না; ডলির আব্বা ড্রয়িংরুমে আমাকে ডেকেছেন। তাকে কি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে? মনেই পড়ে না কখনো আমি কাউকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছি কি না। আমি ঢুকতেই তিনি দাঁড়ান; মনে করেছিলেন পায়ে হাত দেবো, আশীর্বাদ করার একটি ভঙ্গিও তিনি করে উঠছিলেন, আমি দাঁড়িয়েই থাকি দেখে তিনি এক সময় বসেন, আমাকেও বসতে বলেন।
ডলির আব্বা বলেন, তোমাকে আমরা পছন্দ করি, আনিস; তোমার সাথে যদি আমাদের আগে দেখা হতো তাহলে সব কিছু অন্য রকম হতো।
আমি বলি, আমার ভালো লাগছে আপনারা আমাকে পছন্দ করেন। তবে আগে দেখা হলে আমাকে আপনাদের পছন্দ নাও হতে পারতো।
তিনি বলেন, না, না, পছন্দ হতোই; তোমাকে পছন্দ না করার কিছু নেই।
আমি বলি, আপনারা বেশ ভালো।
তিনি বলেন, ডলি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।
আমি বলি, আপনি বোধ হয় ভয় পাচ্ছেন।
তিনি বেশ বিব্রত হন; বলেন, কেনো ভয় পাবো, কেনো ভয় পাবো? তোমার মতো ছেলের কাছ থেকে ভয় পাবো কেনো?।
আমি বলি, আপনি ভুলতে পারছেন না ডলির আগে বিয়ে হয়েছিলো।
তিনি বলেন, তা কী করে ভুলি, বাবা? তোমার সাথেই যদি ডলির প্রথম বিয়ে হতো তাহলে প্রকৃত সুখ পেতাম।
আমি বলি, তাতে এমন কি পার্থক্য ঘটতো।
ডলির আব্বা কোনো কথা খুঁজে পান না, কিন্তু তিনি প্রচুর কথা খুঁজতে থাকেন বলে মনে হয়; তাঁর কথাগুলো হয়তো ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ভেবে তিনি চারদিকে তাকাতে থাকেন, কিন্তু কোনো দিক থেকে কথারা সাড়া দেয় না। আমার উঠে যেতে ইচ্ছে করে, তবে উঠে যেতে পারি না; দ্রলোকের দিকে আমি নিঃশব্দে তাকাই, বারবার তাকাই; আমার মনে হয় তিনি চান আমি উঠে যাই, কিন্তু আমি উঠে যেতে পারি না।
আমার ঘরে ঢোকার আগেই সেই তীব্র সুগন্ধটি আমি পাই, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে না; আমি দরোজায় দাঁড়িয়ে সুতীব্র সুগন্ধ বেশ কয়েকবার ভেতরে টেনে নিই; ঢুকে দেখি ডলি অজস্র গোলাপের মতো লাল হয়ে আছে। ওই লালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো একটা আকস্মিক উত্তেজনা আমি বোধ করি, কিন্তু আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি না; পরমুহূর্তে আমার মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়লেই ভালো হতো, এমন লালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উত্তেজনা হয়তো আমার শরীরে দ্বিতীয়বার দেখা দেবে না। বিছানার মাঝখানে বসে আছে ডলি, বড়ো একটি ঘোমটাও দিয়েছে; তাকে লাল আর সুগন্ধি করে তুলতে সময় লেগেছে, এজন্যেই বেলা আমাকে রাত দশটা পর্যন্ত ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখেছে। আমার ঢোকার শব্দে ডলির ঘোমটা পড়ে যায়; আমার চোখ আজো প্রথমেই তার কাঁধের ওপর গিয়ে পড়ে, চিবুকের ওপর দিয়ে পড়ে। দেলোয়ারের বউকে দেখছি-এমন একটি কালো ঝিলিক আমি বোধ করি, একটু অপরাধবোধও জন্মে; পরেই আমি অনুভব করি, এ হচ্ছে ডলি, আমার বউ, যে এখন আমার দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি না আমি কী করবো। আমি কি দরোজা বন্ধ করবো? ডলি কি চাচ্ছে আমি দরোজা বন্ধ করি?
আমি বলি, ডলি, দরোজা বন্ধ করবো?
ডলি সাড়া দেয় না। আমার মনে হয় ডলি চায় আমি দরোজা বন্ধ করে দিই; বেশ শব্দ করেই আমি দরোজা বন্ধ করি। আমি চেয়েছিলাম এমনভাবে বন্ধ করবো যাতে কোনো শব্দ না হয়; এতো শব্দ হওয়াতে আমিই বিস্মিত হই; ডলিও বিস্মিত হয়ে তাকায়।