সচিবের ঘরে ঠিক দশটায় আমি ঢুকি; সচিব আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেন।
আমি বলি, বসবো, স্যার?
তিনি বলেন, বসুন।
সচিবের কথা শুনে তিন সদস্য অবাক হন; খুশিও হন; তারা বুঝে ফেলেন সচিবের আমি প্রিয় নই; এখন থেকে আমাকে যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করা যাবে।
সচিব বলেন, আমাদের আজকের আলোচনা চূড়ান্ত গোপনীয়।
নেতা বলেন, জি স্যার, জি স্যার।
সচিব বলেন, তারা বলেছে শ্রমিক নেয়ার ও ফিরিয়ে দেয়ার বিমান ভাড়া তারা দেবে, আমাদের মনে হয় এটার দরকার নেই।
নেতা বলেন, জি স্যার, জি স্যার। নিজেরাই বিমান ভাড়া দিয়ে যাওয়া আসার জন্যে লাখ লাখ ছোঁকরা পাগল হয়ে আছে।
এক সদস্য বলেন, বিমান ভাড়া দিয়ে যেতে না পারলে আর সৌদি যাওয়ার কী দরকার স্যার, দেশেই ঘাস কাটতে পারে।
সচিব বলেন, আপনারা সেখানে গিয়ে এ-চুক্তিই করবেন।
নেতা আর সবাই বলেন, জি স্যার, জি স্যার।
সচিব বলেন, আর মাসে তিরিশ হাজার টাকা বেতনও দরকার নেই, পনেরো হাজার হ’লেই চলে।
সবাই চিৎকার করে ওঠেন, জি স্যার, আমরা নিজেরাই যেখানে কটা টাকা মাত্র পাচ্ছি; চাকরগুলো এতো বেতন কেনো পাবে?
সচিব বলেন, ভালোভাবে আপনাদের এসব চুক্তি করে আসতে হবে; আর–
সবাই বলে ওঠেন, জি স্যার?
সচিব বলেন, এতে ওদের কয়েক মিলিয়ন ডলার বাঁচবে। যা বাঁচবে, তার এইটি পার্সেন্ট আমাদের দিতে হবে, সুইস ব্যাংকে জমা দিতে হবে, দুটো অ্যাকাউন্টে।
সবাই বলেন, জি স্যার।
সচিব বলেন, আপনারা প্রত্যেকে পঞ্চাশজন করে পাঠাতে পারবেন; তবে দেখবেন আপনারা ওখানে থাকতে থাকতেই যাতে সুইস ব্যাংকে ডলার জমে; অ্যাকাউন্ট দুটোর নম্বর নিয়ে যাবেন।
সভা শেষ হয়ে আসছে; আমি বলি, স্যার, আমার একটি কথা আছে।
সচিব বিরক্ত হন, আমার দিকে তাকান; কোনো কথা বলেন না।
আমি বলি, আমার যাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না, স্যার।
সচিব অবাক হন না; অন্য তিনজন অবাক হন।
সচিব বলেন, কেনো যেতে পারবেন না?
আমি বলি, আমি গতকাল বিয়ে করেছি, স্যার।
নেতা বলেন, আমাদের না জানিয়েই করে ফেললেন? কোথায় করলেন?
আমি বলি, হঠাৎ করে ফেললাম; এক বন্ধুর স্ত্রীকে।
সচিব বলেন, প্রথমবারই বন্ধুর স্ত্রীকে এর পর কাকে করবেন?
আমরা কেউ বুঝতে পারি না আমাদের হাসতে হবে, না গম্ভীর হতে হবে।
আমি সাধারণত বাসায় ফোন করি না; আজ নম্বরটি মনে করতে গিয়ে মনে করতে পারি না; তিন চারটি নম্বর আমার মনে পড়ে,-হয়তো এটি হবে, হয়তো ওটি হবে, নয়তো এটি হবে; আমি একটির পর একটি নম্বরে ফোন করতে থাকি।
একটি নম্বরে ফোন করতেই একজন বলে, হ্যালো, দেলোয়ার বলছি।
আমি বলি, দেলোয়ার, তুমি কেমন আছো?
সে বলে, আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
আমি বলি, আমি আনিস বলছি।
সে বলে, আনিস, কোন আনিস?
আমি বলি, তোমার বন্ধু আনিস।
সে বলে, আনিস নামে আমার কোনো বন্ধু নেই, অন্তত এখন মনে পড়ছে না।
আমি বলি, আছে, তুমি মনে করতে পারছে না।
সে বলে, তাহলে বলো তোমার সাথে আমার শেষ দেখা কোথায়?
আমি বলি, ফেরিঘাটে।
সে বলে, কোনো বন্ধুকে নিয়ে আমি কখনো ফেরিঘাটে যাই নি।
আমি বলি, ওই যে গাড়ি নিয়ে তুমি পানিতে পড়ে গেলে।
সে বলে, আমি পানিতে পড়ে গেলাম? গাড়ি নিয়ে? পাগল। ঘটরর করে সে ফোন রেখে দেয়।
আমি আবার ফোন করি, বলি, আমি আনিস বলছি।
বেলা বলে, ভাইয়া?
আমি বলি, এটা আমাদের বাসা না কি রে?
বেলা বলে, হ্যাঁ, আমাদের বাসাই, অন্য বাসা না; খুব আনন্দ লাগছে তোমার বাসায় ফোন করার অভ্যাস হচ্ছে।
আমি বলি, ভুলে করে ফেলেছি।
বেলা বলে, আহা, বানিয়ে কথা বলার দরকার নেই; ধরো, ভাবীকে দিচ্ছি।
ডলি বলে, তোমার ফোন পেতে খুব ইচ্ছে করছিলো।
আমি বলি, আসলে কি জানো, আমি বাসায় ফোন করতে চাই নি।
শুনে ডলি স্তব্ধ হয়ে যায়। আমি ডাকি, ডলি।
ডলি বলে, তাহলে কোথায় ফোন করতে চেয়েছিলে?
আমি বলি, একটি ভুল নম্বরে ফোন করেছিলাম, লোকটি ফোন তুলেই বললো, দেলোয়ার বলছি।
ডলি আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। আমি ডাকি, ডলি।
ডলি বলে, বলো।
আমি বলি, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
ডলি বলে, আমার ইচ্ছে করছে এমন কিছু করি যাতে কেউ আমাকে আর দেখতে না পায়।
আমি বলি, কিন্তু তখনো আমি তোমাকে দেখতে পাবো।
ডলি বলে, কী করে পাবে?
আমি বলি, পাবো, যেমন এখন আমি দেলোয়ারকে দেখতে পাচ্ছি।
ডলি চিৎকার করে, ওই নাম তুমি আর নেবে না।
আমি সচিবকে সম্বোধন করে একটি আবেদনপত্র লিখতে বসি; লিখতে আমার ইচ্ছে করে না, আমি ব্যক্তিগত সহকারীকে ডাকি। আমি যা বলি লিখতে লিখতে সহকারী হঠাৎ থেমে যান; আমি বেশ অবাক হই।
আমি বলি, লিখছেন না কেনো?
সহকারী বলেন, স্যার, সত্যিই আপনি যাবেন না?
আমি বলি, আপনার সন্দেহ হচ্ছে কেনো?
তিনি বলেন, গেলে স্যার আপনার চার-পাঁচ লক্ষ টাকা থাকতো।
আমি বলি, জানেন আমার একশো কোটি টাকা দরকার।
তিনি বলেন, জি স্যার।
আমি বলি, কিন্তু একশো কোটি টাকা কি আমি পাবো?
তিনি বলেন, জি না, স্যার।
আমি বলি, যদি একশো কোটি না পাই তাহলে চার-পাঁচ লাখ আমার দরকার নেই।
তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেনো খুঁজতে থাকেন।
আমি, মনে মনে, ডলির মুখের দিকে তাকাই; তার চিবুকের এক অংশ দেখতে পাই; চোখ স্থির হয়ে আছে, গ্রীবায় একটি তিল, নাকের নিচে লোমের সামান্য আভাস দেখতে পাই; আমি দাগগুলো আঙুল দিয়ে ঘষতে থাকি, ঘষে ভোলা ময়লা ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিই, উড়তে উড়তে সেগুলো কোথায় যায় আমি দেখতে পাই না, ঝলমল করে ওঠে ডলি; এবং ডলির জন্যে আমি কষ্ট পেতে থাকি। এমন কষ্ট আমি আগে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। ডলি আমার স্ত্রী? স্ত্রী কাকে বলে? সারাজীবন ডলি আমার স্ত্রী থাকবে? আমি স্বামী থাকবো? আমরা একসঙ্গে ঘুমোবো, খাবো, ডলিকে শাড়ি কিনে দেবো, রিকশায় দুজন দু-দিকে তাকিয়ে থেকে বেড়াতে যাবো? ডলি মোটাগাটা হয়ে উঠতে থাকবে; ওর মুখের প্রান্তগুলো ধীরেধীরে একাকার হয়ে যাবে। ডলি মাঝেমাঝে প্রসব করবে? তারা এসে শক্ত করে তুলবে আমাদের বন্ধন; আর বিচ্ছিন্ন হতে পারবো না, যতোই আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছে হোক? ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে আমার ডলির কাছে; আমি ক্ষমা চাইতে থাকি, আমি খুব অপরাধ করেছি, গতরাতে অনেক স্বপ্ন দেখানোর কথা ছিলো আমার, তুমি জেগে জেগে অনেক স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলো, আমি কোনো স্বপ্নই সৃষ্টি করতে পারি নি; গতরাতই ছিলো তোমার একমাত্র স্বপ্নহীন রাত। দেলোয়ার তোমাকে অনেক স্বপ্ন দিতো, আমি দিতে পারি নি; আমি ক্ষমা চাই, তুমি আমাকে স্বপ্ন সৃষ্টির ইন্দ্রজাল শিখিয়ে দাও, যেমন দেলোয়ারকে শিখিয়েছিলে।