একটু পর ডলির জন্যে আমি কষ্ট পেতে থাকি; তাকে বিয়ে করতে আমাকে সে বলে নি; বরং সে আমার কথা রেখে একটি সম্পূর্ণ দিন আমাকে সুখী করেছে। একটি সম্পূর্ণ দিন আমি কখনোই সুখী থাকি নি পনেরো বছর হওয়ার পর। আমি যখন আজ তাকে বেবিতে উঠতে বলি, যদি সে উঠতে রাজি না হতো, বলতো, আপনাকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতে পারি না; আপনি ভুল বুঝেছেন আমাকে; আপনাকে আপন মনে করেছি শুধু আমরা একই অপরাধ করেছি বলে, তাহলে একটি সম্পূর্ণ সুখের দিন আমি কখনোই পেতাম না। ডলি কোনো কথা বলছে না, আমি কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি; প্রথম মনে হচ্ছিলো আমি নিজেই কাঁদছি, পরে বুঝতে পারি কাঁদছে ডলি। দেলোয়ার নদীতে ডুবে যাওয়ার পরও ডলিকে কাঁদতে দেখি নি; আজ তার কাঁদার কথা নয়, আজ সম্পূর্ণ একটি দিন আমি তাকে সুখে রেখেছি, পনেরো বছর হওয়ার পর, কাউকে আমি একটি সম্পূর্ণ দিন সুখী রাখতে পারিনি, কেউ আমার কাছে সুখী হতে চায় নি, কাউকে আমি সুখী করে উঠতে পারি এমন কথা কেউ ভাবে নি; শুধু ডলিই আমাকে সুখী করতে চেয়েছে আর সুখী হতে চেয়েছে। ডলিকে আমি চিনিই না, কাউকেই আমি চিনি না; আমাকেও ডলি চেনে না। আমাকে কনডম কিনতে দেখে ডলি কী ভেবেছিলো? আমাকে খারাপ ভাবছিলো? তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার তো মনে হচ্ছিলো তার একটি ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, যে-ভাবনাটি কখনো সে প্রকাশ করে উঠতে পারতো না। এখন ডলি কী পাথরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? সে কি বরফ হয়ে গেছে? আমি যদি তাকে ছুঁই সে কি আমাকে সহ্য করবে? ডলির কান্না এখন আর শুনতে পাচ্ছি না, সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছি? আমি যদি ঘুমিয়ে পড়তে না পারি ডলি কী করে ঘুমোতে পারবে? সে হয়তো তার নিজের বিছানাটির কথা ভাবছে। হয়তো দেলোয়ারকে ভাবছে। কেনো ভাববে না? আমার মনে পড়ছে, নারায়ণগঞ্জের মেয়েটিকে। ওই মেয়েটির শরীরে আমি অন্য কাউকে দেখতে পাই নি, কোনো দাগ দেখতে পাই নি, ময়লা দেখতে পাই নি; তাহলে ডলির শরীরে আমি এতো দাগ কেনো দেখলাম?
আমি ডাকি, ডলি।
ডলি বলে, বলো।
আমি বলি, দেলোয়ারকে মনে পড়ছে?
ডলি বলে, না।
আমি বলি, আমি দুঃখিত।
ডলি কোমলভাবে আমার ডান হাতটি ছোঁয়; মনে হয় বেশি ছুঁতে সাহস পাচ্ছে না; আমার মনে হয় ডলি আরো ছুঁক, কিন্তু আমি বলতে পারি না।
আমি বলি, দেলোয়ার আমাকে বহু বছর অপরাধবোধের মধ্যে রেখেছিলো।
ডলি বলে, আমি জানি।
আমি বলি, কী জানো?
ডলি বলে, আমি বলতে পারবো না।
আমি বলি, আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম।
ডলি বলে, ওই কথা রাখো, ওই কথা রাখো।
আমি বলি, আমি খুব খারাপ।
ডলি বলে, না।
আমি বলি, দেলোয়ারই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো।
ডলি বলে, দেলোয়ার আমাকে তা বলে নি।
অফিসে গিয়ে দেখি
অফিসে গিয়ে দেখি নির্দেশটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে; প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে নির্দেশের এক কপি পাঠানো হয়েছে আমার কাছেও;–একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের এক উচ্চপর্যায়ের পর্যবেক্ষক দল অবিলম্বে সৌদি যাচ্ছে; আমি ওই দলের চতুর্থ সদস্য। হাসি পায় আমার; ইচ্ছে হয় ডলিকে টেলিফোন করে জানাই আজ বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে, সৌদি যাচ্ছি, উচ্চ পর্যবেক্ষক দলের আমি চতুর্থ সদস্য। নির্দেশের সাথে আরেকটি নির্দেশও রয়েছে; আজই দশটায় সচিবের কক্ষে পর্যবেক্ষক দলের সাথে সচিবের বৈঠক হবে, আমাকে থাকতে হবে। সচিবের ঘর থেকে বেরিয়ে আর সময় পাবো না, সরাসরি বিমানে গিয়ে উঠতে হবে; ডলিকে এখনই জাতীয় সংবাদটি জানিয়ে খুব উচ্চকণ্ঠে আমার হাসতে ইচ্ছে করে। আমি হাসি না, টেলিফোনের পর টেলিফোন আসতে থাকে-অনেকেই সংবাদ পেয়ে গেছে, সৌদিতে আট হাজার দাস পাঠানো হচ্ছে, আমি চতুর্থ সদস্য; আমি ঘড়ির দিকে তাকাই, দশটা বাজার সময় আর বেশি নেই। আমাকে সৌদি যেতে হবে? ওমরা করতে হবে? আমিও পঞ্চাশটি পাঠাতে পারবো? সচিব কটি পাঠাবেন? মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়? ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখে চুক্তির খসড়া করতে হবে? চুক্তিতে কী থাকবে? সচিবই নিশ্চয়ই আজ বলে দেবেন চুক্তিতে কী থাকবে; ঘরে ফিরে চুক্তির ভাষাটি হয়তো আমাকেই তৈরি করতে হবে।
ডলি কি বাসায় ফোন করেছে? করে থাকলে ডলির সবাই এখন আমাদের বাসায়। সারারাত তারা হয়তো ডলির আর আমার মতোই ঘুমোতে পারে নি। তারা কি রাতভর ছুটোছুটি করেছে। পুলিশের কাছে গেছে? হয়তো যায় নি। একটি রাত দেখতে চেয়েছে? আমি যে ডলিকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, তারা তা জানে; ডলিকে যে আমি খুন করে ফেলবো না, অন্তত খুন করে উঠতে পারবো না, এটাও তারা সম্ভবত জানে। আমি যে তাদের মেয়েটির কাছে যেতাম, তা কি তারা ঘেন্না করতো? তাদের দুঃখী মেয়েটিকে তারা কেনো আমার সাথে বেরোতে দিতো? তারা কি ভাবতো আমার সাথেই শুধু তাদের দুঃখী মেয়েটি সুখে থাকে? ডলি খুব চমৎকার মেয়ে। ডলি কী করছে এখন? ভেঙে পড়েছে? ভুল করে ফেলেছে ভেবে মায়ের বুকে মুখ রেখে নিঃশব্দে কাঁদছে? নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে অলৌকিক শক্তির খেয়ালের কাছে; মনে পড়ছে দেলোয়ারকে? তুলনা করছে, বারবার তুলনা করছে? কনডমের প্যাকেটগুলো আমি টেবিলের ওপর ফেলে রেখেছিলাম, ডলি কি ড্রয়ারে তুলে রেখেছে; কোনো দিন লাগবে না ভেবে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে? ফেলে দেয় নি হয়তো, অতো তীব্র মেয়ে নয়। ডলি; নিশ্চয়ই ড্রয়ারে বা বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে। ওগুলো কাজে লাগবে? ওমরা করে আসার পর? ফেলে দিলে কেমন হয়? আমি কি ওগুলো পরতে পারবো? মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সাতদিনের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স করে নিতে হবে? বরং ওমরা করে আসার পর ওগুলো ফেলে দিয়ে কিছু একটা করতে পারি, তাতে একটা পবিত্র পুত্র জন্মাতে পারে।