বাবা বলেন, তুমি তো এমন ছিলে না।
আমি বলি, পনেরো বছর হওয়ার পর আপনি আর আমাকে জানেন না।
বাবা উঠে চলে যান।
কাপড় বদলিয়ে আমি টয়লেটে যাই, ফিরে এসে শুয়ে পড়ি; বালিশের নিচে একটি বই পড়ে ছিলো, হাতে ঠেকতেই তুলে নিই বইটি নিষিদ্ধ, আমার প্রিয় বইয়ের একটি পাতা খুলেই আবার দেখতে পাই–উর্বরতার দেবীরাই তখন ছিলো প্রধান দেবী, তাদের হটিয়ে আসে পুরুষ দেবতারা; বিশাল কালো পাথরটি ছিলো উর্বরতার দেবী আফ্রোদিতির মূর্তি, যার যোনিদেশে চুমো খেতে ভক্তরা, কেননা মাটি যেমন জন্ম দেয় শস্য তেমনি নারীর ওই প্রত্যঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসে রহস্যময় সন্তান। পাথর আকাশ থেকে পড়ে নি। শস্য আমার পছন্দ, কিন্তু সন্তান সম্পর্কে আমার দ্বিধা রয়েছে; সন্তান জন্ম দেয়ার প্রণালিটি আমার ভেতরে ঘেন্না জাগায়। বেলা ডলিকে নিয়ে আমার ঘরে ঢোকে। ডলি লাল টকটকে নতুন শাড়িটি পরেছে। আমার নারায়ণগঞ্জের কথা মনে পড়ে; দেলোয়ার আমাকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাচ্ছে; আমি দেখতে পাই মেয়েটি আমাকে ব্লাউজ খুলতে দিচ্ছে না; পুলিশ আমার কাছে দশ টাকা চাচ্ছে; দেলোয়ার বলছে, তুমি অপবিত্র। ডলি কি আমার সাথে ঘুমোবে? আমি কি ডলির সাথে ঘুমোবো? ডলির ওই লাল টকটকে শাড়ি কি আমার খুলতে হবে? ডলি কি খুলতে দেবে? ডলির শাড়ি খোলার কোনো আগ্রহ আমি ভেতরে বোধ করছি না। ডলি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দরোজা বন্ধ করে দেয়, এবং এসে বিছানায় বসে।
আমি বলি, তোমাকে আমি চিনতে পারছি না।
ডলি বলে, আমি তোমার বউ।
আমি বলি, এতো সুন্দর বউর কথা আমি কখনো ভাবি নি।
ডলি বলে, আমি সুন্দর নই।
আমি বলি, তোমার সৌন্দর্য দেখে আমার ভয় লাগছে।
ডলি বলে, এ-সৌন্দর্য নষ্ট হতে বেশি সময় লাগবে না।
আমি বলি, ওঠো, উঠে শুয়ে পড়ো।
ডলি বলে, আমাকে ধরে উঠোও, নইলে আমি উঠতে পারবো না।
আমি ডলিকে ধরে উঠোতে গিয়েই দেলোয়ারের মুখ দেখতে পাই। আমি ডলিকে আর উঠোতে পারি না; দেলোয়ার শক্ত হাতে ডলিকে ধরে রেখেছে, আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে, আমি পেরে উঠছি না।
ডলি বলে, আমি তোমার বউ, আমাকে ধরো।
আমি বলি, ডলি, আমি তোমাকে ধরতে পারছি না।
ডলি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার মুখের দিকে তাকাও।
ডলির মুখটি আমার অঞ্জলিতে নেয়ার জন্যে আমি হাত বাড়াই, মুখটি আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে, অঞ্জলিতে স্থান পেতে চায়; আমি দেখতে পাই দেলোয়ার হাত দিয়ে ডলির মুখ ঢেকে রেখেছে, দেলোয়ারের অঞ্জলিতে ওই মুখ আধোঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে; তার অঞ্জলি আমি সরাতে পারি না; বারবার চেষ্টা করতে থাকি, কিছুতেই সরাতে পারি না; দেলোয়ারের আঙুল ডলির মুখে ময়লা দাগের মতো লেগে থাকে; এক সময় তার আঙুল সরিয়ে দুটি উজ্জ্বল রক্তের দাগের মতো ডলির ঠোঁটের দিকে আমি ঠোঁট বাড়াই; বাড়াতে গিয়েই দেখি দেলোয়ারের ঠোঁট লেগে আছে সেখানে, তার ঠোঁট খসতে চাচ্ছে না; দেলোয়ারের ঠোঁটের চাপে ওই ঠোঁট রক্তগোলাপের মতো ফুটে উঠছে; আমি ঠোঁট ফিরিয়ে নিই; ডলি শাদা পাথরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকে; কিন্তু ডলি আমার, ডলিকে উদ্ধার করতেই হবে, ডলি আমার বউ; আমি টান দিয়ে ডলির লাল শাড়িটি খুলে মেঝের দিকে ছুঁড়ে ফেলি, আমার মনে হয় অন্য কেউ শাড়িটি ছুঁড়ে ফেললো, নোংরা হয়ে গেলো শাড়িটি; তার ব্লাউজ খুলতে গিয়ে অন্য কারো হাতের সাথে আমার আঙুলের ঘর্ষণ লাগে; ওই হাত অনেক আগে থেকেই খুলছে ডলির ব্লাউজ; সে-হাত বারবার আমার আঙুলগুলোকে ফিরিয়ে দিতে থাকে; আমি ডলির ব্লাউজ টেনে চারপাঁচ টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলি, ছেঁড়ার শব্দ মধুর লাগে আমার; ডলির কম্পমান চাঁদের আলোয় আমার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে; ওই অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে দেখি অন্ধকারের ভেতরে বসে আছে অন্য কেউ; আমার চোখে আরো গাঢ় অন্ধকার নামে; ডলিকে আর ডলি মনে হয় না, নদীর ওপর দীর্ঘ চর মনে হয়; ওই চরে আমি যেখানেই যেতে থাকি, সেখানেই দেখি দেলোয়ার ঘর বানিয়েছে, চাষ করেছে, লাঙ্গল চালিয়েছে, ধান পাট সরষে তিল যব কাউন কুমড়ো শিম বুনেছে; দিঘি কেটেছে, জল টলমল করছে; এ-জমি থেকে আমন তুলেছে, ওই জমি থেকে আউশ; পুবের জমি থেকে মশুর, পশ্চিমের জমি থেকে কলই; আমি ডলির বাহু থেকে বগল থেকে নাভিতে ছুটতে থাকি; লাল তিল থেকে ধূসর তিলে দৌড়োতে থাকি-প্রত্যেকটিই দেলোয়ারের; হেঁটে হেঁটে। বাহুতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; হেঁটে হেঁটে বগলে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; গড়াতে গড়াতে নাভিতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; হামাগুড়ি দিয়ে জংঘায় গিয়ে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; পায়ের তালুতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; শত শত মাইল পেরিয়ে সোনার খনিতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; আমি অন্ধ হয়ে যেতে থাকি, অন্ধত্বের ওপারে এক অদ্ভুত জ্যোৎস্নাই শুধু আমার চোখ দুটিকে। ম্লানালোকিত করে রাখে; ওই অন্ধ আলোর ভেতরে আমি ডলিকে দেখার চেষ্টা করি, দেখতে পাই না; আমার মনে হয় ডলি আমার স্ত্রী নয়, এ-শরীর যার সে আমার স্ত্রী নয়; অন্য কারো; আমি নিঃশব্দে ডলির শরীর থেকে খসে পড়ি।