দশটার দিকে আমি বেরিয়ে পড়ি; একটু বৃষ্টিতে ভিজি; ডলিদের বাসায় যাই। ডলি অবাক হয়; ডলির অবাক হওয়া দেখে আমি সুখ পাই।
ডলিকে বলি, একটি সুন্দর শাড়ি পরে এসো।
ডলি চমকে ওঠে, কেনো?
আমি বলি, আমরা বাইরে যাবো।
ডলি বেশ তাড়াতাড়ি শাড়ি পরতে পারে; আমার চমৎকার লাগে; আমরা দরোজা খুলে বেরোই। দূরে দাঁড়ানো বেবিটাকে আমি ডাকি।
ডলি জিজ্ঞেস করে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমি বলি, কোর্টে-আমরা বিয়ে করবো।
ডলি একবার আমার দিকে তাকিয়ে উঠে বেবির ডান দিকে বসে, আমি উঠে বা দিকে বসি।
সব কিছু হয়ে গেলে লোকটি বলে, কাজির অফিসে গিয়ে একবার বিয়ে পড়ে নেবেন।
আমি জানতে চাই, কেনো?
লোকটি বলে, আপনারা মুসলমান তো।
আমি বলি, তাহলে এখানে এলাম কেনো?
আমি ডলির ডান হাতটি ধরে পা বাড়াই, ডলিও আমার সাথে পা বাড়ায়।
ডলি বলে, তোমার বউকে তুমি এখন কোথায় নেবে?
আমার রক্তের অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে ঝলমলানো রোদ ঢুকতে থাকে, আমার মাংস ঝলমল করে ওঠে; আমি বৃষ্টির মধ্যেই পা বাড়িয়ে দিই। আমার মনে পড়ে না যে বাইরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে। ডলিও আমার সাথে পা বাড়ায়। ডলি আমার বা হাতটি ধরে আছে। অনেকগুলো রিকশা ভিড় করে এসেছে, দু-তিনটি বেবি খুব চিৎকার করছে, আমি আর ডলি বেবি বা রিকশার কথা ভাবতে পারছি না, কোনো যানবাহন যে আমাদের দরকার পড়তে পারে, আমাদের তা মনে হচ্ছে না।
আমি ডলিকে জিজ্ঞেস করি, তোমার এখন কী ইচ্ছে করছে?
ডলি বলে, এতো কিছু ইচ্ছে করছে যে ব’লে সারাজীবনেও শেষ করতে পারবো না।
আমি বলি, অন্তত একটি বলো।
ডলি বলে, তোমার হাত ধরে হাঁটতেই ইচ্ছে করছে।
আমি বলি, আমার খুব দূরে যেতে ইচ্ছে করছে।
ডলি বলে, তাহলে তা-ই চলো।
আমি বলি, হেঁটে অতো দূর যাওয়া যাবে না।
ডলি বৃষ্টির থেকেও নিবিড় হেসে বলে, তাহলে একটা প্লেন ভাড়া করো।
কংকর্ডের থেকেও দ্রুত ও শব্দিত একটি বেবি এসে আমাদের সামনে থামে; আমরা উঠে বসি, ডলি ডান দিকে আমি বাঁ দিকে।
আমি ড্রাইভারকে বলি, শহর পেরিয়ে যে-দিক ইচ্ছে যাও, খুব দূরে।
বেবি চলতে শুরু করে। আমরা যে-দুজনই ভিজে গেছি, এটা প্রথম মনে পড়ে। ডলির; সে তার ব্যাগ থেকে একটি ছোটো তোয়ালে বের করে, আমার চশমাটি খুলে নিয়ে মুছে পরিয়ে দেয়, এবং আমি ডলিকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই। আমি যখন তাকে স্বচ্ছভাবে দেখতে থাকি, সে তোয়ালেটি আমার শরীরের এদিক সেদিক বুলোতে থাকে; ঘষে ঘষে চুলগুলো শুকিয়ে ফেলে; আমি একবার ডলির হাত থেকে তোয়ালেটি নিই, ডলি মনে করে আমি হয়তো আমার এমন কোনো অঙ্গ মুছবো যেখানে তার হাত পৌঁছোবে না; আমি তোয়ালেটি দিয়ে তার মুখটি মুছে দেয়ার চেষ্টা করতেই সে আমার হাতটি তার দু-হাতে আস্তে চেপে ধরে। তোয়ালেটি আমার হাত থেকে খসে পড়ে, আমি তার মুখের একরাশ কোমলতা আমার দু-হাতের অঞ্জলিতে ধরে রাখি। বৃষ্টিতে পৃথিবী তখন শাদা হয়ে গেছে, পথঘাট থেকে মানুষেরা মুছে গেছে, আমরা শুধু ছুটে চলেছি। শহর পেরিয়ে অনেক দূরে এসে গেছি আমরা; পথের পাশে আমি একটি ভাঙা নড়োবড়ো ভাতের দোকান দেখতে পাই; দোকানটি বৃষ্টিতে কাকের মতো কাতর হয়ে পড়েছে, কিন্তু ভেতর থেকে একটা গরম গন্ধ বেরোচ্ছে। আমি বেবি থামাতে বলি।
চলো, আমি বলি, ভাত খাই।
ডলি বলে, ভাত? কোথায়?
এ-দোকানে, আমি বলি, খুব মোটা চালের গন্ধ পাচ্ছি।
ডলি বলে, ভাতের সুগন্ধ এটা?
আমরা নামতেই লোক তিনটি পাগলের মতো ছুটোছুটি শুরু করে; কী খাবো আর কী খাবো না জানার জন্যে অধীর হয়ে ওঠে। তারা কি বুঝে ফেলেছে আমরা এইমাত্র বিয়ে করে এসেছি। আমাদের একটা উষ্ণ সংবর্ধনা জানাতো উচিত? পোলাও রোস্ট তৈরি করা দরকার?
আমি ডলিকে বলি, আগে ওরা খবর পায় নি, ভাগ্য।
ডলি বলে, আগে খবর পেলে কী হতো?
আমি বলি, হয়তো লাল নীল কাগজ কেটে গেইটই তৈরি করে ফেলতো।
ডলি বলে, গেইট দিয়ে ঢুকতে আমার মন্দ লাগতো না।
আমি বলি, তাহলে গেইট সাজাতে বলি?
ডলি বৃষ্টির মতো দিকে দিকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে থাকে।
ডলি বলে, ওই লোকটিকেও বলো।
আমি বলি, কাকে?
ডলি বলে, বেবিঅলাকে।
আমি ডাকি, ড্রাইভার, ড্রাইভার।
ডলি আমার পাতে খাবার তুলে দিতে থাকে, আমার অদ্ভুত লাগে। মা আমার পাতে খাবার তুলে দিলেও আমি থামিয়ে দিই; বলি, রাখো তো, রাখো তো, কিন্তু ডলিকে থামাতে পারি না। আমি ডলির আঙুলের দিকেই তাকিয়ে থাকি; তার আঙুলের ভেতর থেকে স্বাদ গড়িয়ে পড়ছে আমার প্লেটে। লাল টকটকে নলা আর ঝাল কাঁচকি মাছ। দিয়ে আমরা ভাত খাই; আমার ঠোঁটজিভ পুড়ে যেতে থাকে। আমাদের জিভে এতো স্বাদ আছে আমরা আগে কেউ জানতাম না; আমি জানতাম না, ডলিও জানতো না।
ডলি বলে, কী যে স্বাদ লাগলো।
আমি বলি, এসো আরেকবার খাই।
ডলি বলে, আরেক দিন খাবো।
শহরে ফিরে একটি শাড়ির দোকানের সামনে আমি বেবি থামাতে বলি।
ডলি বলে, এখানে কেনো?
আমি বলি, আমার কয়েকটি শুকনো শাড়ি দরকার।
যখন বেরোচ্ছি, সন্ধ্যা অনেকটা হয়ে গেছে, বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি একটি বেবির জন্যে ডানে বায়ে তাকাচ্ছি।
ডলি বলে, তোমার বউকে তুমি কোথায় রাখবে?
আমি চমকে উঠি, কথাটি আমি ভাবিই নি; আমি ধরেই নিয়েছিলাম ডলিকে আমি ডলিদের বাড়ি পৌঁছে দেবো, তারপর বাসায় ফিরে আসবো; কিন্তু ডলি যে আজ আমার বউ হয়ে উঠেছে, আমি তা ভুলেই গিয়েছিলাম।