তিনি বলেন, আসুন, ঠিক দিনে এসেছেন।
আমি বলি, তাহলে আমি যাই।
তিনি বলেন, না, না; যাবেন কেনো।
তিনি আমাকে বসার ঘরে না নিয়ে ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলেন, যার জন্যে এসেছেন, তার ঘরেই চলুন। দেখুন কেমন আছে।
সালাম কি ভালো নেই? ও কি অদ্ভুত রকমে খারাপ আছে? ও কি একটা দেখানোর বস্তু হয়ে উঠেছে? দেখে আমি সহ্য করতে পারবে তো?
সালাম মেঝেতে বসে খাটে মাথা রেখে কাত হয়ে আছে, হাতে বেশ বড়ো একটা গেলাশ-মেঝেতে রাখা; সালাম পান করছে, আমাকে দেখে চিনতে পারছে না। আমার থেকে বছর আটেকের বড়ো সালাম, যখনই দেখা হয় জড়িয়ে ধরা তার অভ্যাস; আজ আমাকে চিনতে পারছে না, কিন্তু জড়িয়ে ধরছে ঠিকই। সালাম এখন পৃথিবীর সব কিছু জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো থাকতো; আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু ভালো বোধ করছে। আমারও ভালো লাগছে; এর আগে আমাকে এমন অসহায়ভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে নি; আমি সালামকে বুঝতে দিচ্ছি না যে আমারও সারা পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে, আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে আছি।
সালাম বলে, তুই বোধ হয় সেই ভালো ছেলেটা, যে মদটদ খায় না। সালাম আমার মুখে চুলে আঙুল বুলোতে থাকে।
আমি বলি, খাই না, তা ঠিক নয়।
সালাম বলে, দু-নম্বরের সঙ্গে আজ একটু মনোমালিন্য হচ্ছে। তুই কিছু মনে করিস না; আয়, একটু খা।
সালাম হুহু করে কাঁদতে শুরু করে; শিশুর মতো কান্না, শিশুর থেকে গভীর কান্না। শিশুরা এমন ভেঙে পড়ে কখনোই কাঁদতে পারে না। এই প্রথম আমি কাউকে কাঁদতে দেখলাম।
সালামের বউ বলেন, ওর কান্না দেখে আমার ঘেন্না হচ্ছে। আমাকে ও অপমান করছে।
আমি জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, ভাবী?
সালামের বউ বলেন, ওর মেয়ের আজ ফল বেরিয়েছে।
সালামের আরো কান্না দরকার, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদে; ভেঙে ভেঙে বলে, আমার মেয়ের আজ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, মা আমার মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছে, পত্রিকায় আমার মা বলেছে ওর কোনো আব্বা নেই।
সালাম মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। আমি বুঝতে পারি সালামের এভাবে কান্নার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; কিন্তু কারো দুঃখ কীভাবে অনুভব করতে হয় আমি জানি না। আমি শুধু চেয়ে থাকতে পারি, সালামের দিকে চেয়ে থাকি।
সালাম ডুকরে উঠে বলে, আমার মাকে আমি দেখতে গিয়েছিলাম, মা আমার সাথে দেখা করে নি; ব’লে পাঠিয়েছে ওর কোনো আব্বা নেই।
সালামের বউ বলেন, আর ফিরে এসেই আমাকে বলছে, তুই চিৎ হয়ে শো, তোর পেটে আমি আজই একটা মেয়ে জন্ম দেবো।
সালাম জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, তোর পেটে অমন মেয়ে আসবে না রে আসবে না।
সালামের বউ বলেন, তাহলে সেই রত্নপ্রসবিনীকে নিয়ে থাকলেই পারতে।
সালাম বলে, তোর বাইরটাই রত্নের মতো ঝলমলে, ভেতরে কোনো রত্ন নেই রে, তোর ভেতরে শুধু আবর্জনা।
সালামের বউ বলেন, তোমার মুখে থুতু দিতে ইচ্ছে করছে।
সালাম বলে, অই বউ বেশি ক্ষেপিস না, নিজে একটু খা, আর এই ভালো ছেলেটারে একটু দে।
সালামের বউ আমার জন্যে বেশখানিকটা হুইস্কি ঢালেন, নিজের জন্যে তারও বেশি। আমরা দুজনেই প্রথম চুমুকেই বেশ খানিকটা খাই। খেতে আমার বেশ লাগে, নিজেকে হাল্কা লাগে; আমার মনে হয় আমার ভেতরে একটা শোক আছে, আমার খাওয়া উচিত।
প্রত্যেকটা মানুষ অশ্রুবিন্দুর মতো, সালাম বলে, কখন টলমল করে উঠবে কেউ জানে না। সালামের কণ্ঠ খুব জড়িয়ে গেছে। সে বলে, আমি আজ অশ্রুতে পাপ ধুয়ে ফেলতে চাই।
সালামের বউ খলখল করে হাসতে থাকেন; বলেন, ওই অশ্রুতে পাপ কেনো, চোখের পাতাও ধোয়া হবে না; তোমার চোখের পানিও তোমার মতোই নোংরা।
অই ভালো ছেলে, শোন, সালাম বলতে থাকে, তুই সামনে যে-রত্নটারে দেখছিস, তার মাংসের কণায় কণায় রত্ন জ্বলে; এই রত্নের জন্যেই আমি জীবনটাকে বর্জন করেছি। ওর সঙ্গে যখন শুই আমার জীবনের কথা মনে থাকে না; শোয়া শেষ হলেই মনে পড়ে আমার একটি মা ছিলো, দুটো বাবা ছিলো।
সালাম মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে, ব্যাকুলভাবে বাহু দিয়ে কাদের যেনো জড়িয়ে ধরে সমস্ত হৃৎপিণ্ড দিয়ে চুমো খাচ্ছে। তার আবেগ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, তবু আমার ভেতরও একটা দুঃখ জেগে ওঠে; কিন্তু সালামের বউ খলখল করে হাসতে আর পান করতে থাকেন। তিনি ঝলমল করতে থাকেন, তার শরীর থেকে অজস্র রত্ন ঝলমল করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
আমি উঠে দাঁড়াই।
সালামের বউ বলেন, উঠছেন কেনো, বসুন; আরেকটুকু খান।
আমি বলি, আমি কষ্ট পাচ্ছি, আরেকটুকু বসলে আমিও কাঁদতে শুরু করবো।
তিনি বলেন, আপনার আবার কিসের কষ্ট?
আমি বলি, আমি আমার বন্ধুকে নদীতে ফেলে দিয়েছি।
তিনি হা হা করে হেসে ওঠেন, এটুক খেয়েই বন্ধুকে নদীতে ফেলে দিয়েছেন ভেবে কান্না পাচ্ছে, আরেকটু খেলে তো আমাকে খুন করে ফেলেছেন ভেবে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ফোঁপাতে থাকবেন।
রাতে খুব ঘুম হয় আমার। ঘুমের মধ্যে আমি নিবিড় বর্ষণের শব্দ শুনতে পাই, আমার চোখ মেলতে ইচ্ছে করে না; ছেঁড়া কাঁথার মতো আমার শরীর বিছানার ওপর এলিয়ে থাকে। একেকবার আমার মনে হয় অজস্র সবুজ পাতা ঝরে পড়ছে বনের ভেতর, আমি সেই পাতার স্তূপের নিচে পড়ে আছি, আমার ওপর সবুজ বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টিতে গলে যাচ্ছি আমি, কাদামাটির মতো হয়ে যাচ্ছি। পাতার ভেতর থেকে একটি সবুজ অজগর বেরিয়ে আসে; আমার শরীরের ওপর অজগরটি খেলতে থাকে, আমি অজগরটিকে জড়িয়ে ধরে খেলতে থাকি, অজগর আমার গলা জড়িয়ে ধরে, আমি। অজগরের গলা জড়িয়ে ধরি, অজগর আমাকে চুমো খায় আমি চুমো খাই অজগরকে; খেলতে খেলতে সবুজ পাতার ভেতরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। কখন ভোর হয় আমি বুঝতে পারি না, ঘুম ভাঙার পরও অজগরের স্মৃতি আমার মনে স্পষ্ট জেগে থাকে; একবার আমি কেঁপেকেঁপে উঠি। আমি বিছানা থেকে উঠি না, উঠতে আমার ইচ্ছে করে না; আমি অফিসে যাই না। আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে, বৃষ্টি হচ্ছে মাঝেমাঝেই; আমি চা খাচ্ছি, আবার চা খাচ্ছি, সিগারেট খেতে আমার ছেলেবেলার মতো ভালো লাগছে। সিগারেটে আমি ছেলেবেলার গন্ধ পাচ্ছি।